দিয়েগো ম্যারাডোনা, ফুটবল বিশ্বের এক কিংবদন্তি। ফুটবল জাদুতে তিনি সারা বিশ্ব এমনভাবে মোহিত করেছেন যে যেখানেই যেতেন সবসময় আলোটা তার দিকেই থাকতো।
গত বুধবার (২৫ নভেম্বর) সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন ম্যারাডোনা। 'ফুটবল ঈশ্বর' তার আশীর্বাদ ছড়াবেন অদৃশ্য এক ভুবন থেকে। যতদিন বেঁচে ছিলেন সব সময়ই ছিলেন আলোকিত হয়ে। তার ভক্ত ও সমর্থদের প্রতি সব সময় ছিলেন বন্ধুসুলভ। তার সঙ্গে দেখা হলে কখনই তারকামোহ আচরণ করেননি কারো সঙ্গে। তবে চাইলেও কেউ তার সঙ্গে সহজে দেখা করতে পারতেন না। কিন্তু কারও সঙ্গে দেখা হলে তাকে সহজেই আপন করে নিতেন।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের সৌভাগ্য হয়েছিল ম্যারাডোনাকে সামনা সামনি দেখার। বাংলানিউজের সঙ্গে শেয়ার করেছেন ম্যারাডোনার সঙ্গে দেখা করার সেই অনুভূতি। নিজের আবেগটাও ধরে রাখতে পারেননি তিনি।
মানুষ ম্যারাডোনা সম্পর্কে আবু নাঈম সোহাগ বলেন, 'ম্যারাডোনাকে আমি যে কয়েকবার দেখেছি, আমার কাছে মনে হয়েছে সে যেখানেই যায় সেই জায়গাটায় আলোকিত করে রাখে। সকল মনোযোগ তার দিকে থাকে। অটোগ্রাফ, সেলফি, একটু হায়-হ্যালো করা, হ্যান্ডশেক করা। এগুলো করতে তো মানুষের মধ্যে একটা ক্লান্তি থাকার কথা, এরকম তারকামোহ কখনো দেখিনি তার মাঝে। আমার কাছে মনে হয়েছে সে খুব ফ্রেন্ডলি এবং খুব সহজেই যে কাউকে আপন করে নেয়। '
তিনি মনে করেন ম্যারাডোনা যা করে দেখিয়েছেন সেটা ফুটবল বিশ্ব আর কোনো দিন দেখবে না। ম্যারাডোনা নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে সেই পর্যায়ে আর কেউ পৌঁছাতে পারবে না। ম্যারাডোনা ফুটবলকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছেন।
তিনি বলেন, 'ফুটবল সবসময় একা দলগত খেলা, কিন্তু ম্যারাডোনা দেখিয়েছেন কিভাবে একটা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে একটা লোক, একটা অধিনায়ক, একজন খেলোয়াড় একা বিশ্বকাপ জেতায়। এটা আমার মনে হয় না আর কখনো বিশ্ব দেখবে, কখনো কোনো দিন কোনো বিশ্বকাপে এটা সম্ভব হবে না। ম্যারাডোনার সেই ধরনের ফুটবলার ছিলেন, যার সক্ষমতা ছিল দলকে নেতৃত্ব দিয়ে সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। ফিজিক্যালি ম্যারাডোনা মারা গিয়েছে, কিন্তু ম্যারাডোনার যে কীর্তি, ফুটবল মাঠে তার অবদান, তিনি যেসব ফিলিংস ক্রিয়েট করেছেন সেটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ফুটবলকে যে ভালোবাসে ম্যারাডোনাকে সে ভালবাসতে বাধ্য হয়েছে। '
ম্যারাডোনার সঙ্গে দেখা করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল এমন প্রশ্ন করতেই বাফুফের সাধারণ সম্পাদক বিস্তারিত জানালেন তার অভিজ্ঞতার কথা, 'এটা ছিল ফিফা বিশ্বকাপ ২০১ ‘র ১৬ই জুন। স্টেডিয়ামটা ছিল স্পার্তাক স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচ ছিল এটা আইসল্যান্ডের বিপক্ষে। আমি যেখানে বসা ছিলাম তার পাশেই ছিল ফিফা লাউঞ্জ। সেখানে আমার কিছু কলিগের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। একটু পর দেখলাম সাত-আটজনের একটা প্রাইভেট সিকিউরিটি দল ঢুকলো। তখন আমি এটা পাত্তা দেইনি, পরে দেখলাম যে লাউঞ্জের মধ্যে গুনগুন, ফিসফিস হচ্ছে। তখন মনে হল যে কেউ একজন ঢুকেছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি ঢুকেছে। তখনও আমি বুঝতে পারিনি সেটা ম্যারাডোনা ছিল, পরে ভালো করে দেখলাম যে সেটা ম্যারাডোনা ছিল। আমি দেখেই শিহরিত হয়ে ছিলাম। পরে একটু ফলো করলাম তাকে। দেখলাম যে এক থেকে দেড়শ জনের একটা লাইন তৈরি হয়ে গেল। সবাই ম্যারাডোনাকে দেখতে, হাই-হ্যালো ও ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে গেল। আমিও সেই লাইনে গিয়ে ঢুকলাম। পরে দেখলাম যে সিকিউরিটি কাউকে অ্যালাউ করছে না। '
'এরপর আমি লাইন ভেঙে সামনে চলে এলাম। সিকিউরিটিকে রাজি কররা পরিকল্পনা করলাম, সুযোগটা নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমি দেখলাম কাকে আমি রাজি করাতে পারবো। একটা বিষয় বলে রাখি ম্যারাডোনা কিন্তু ইংরেজি খুব কম বুঝতো। তার সিকিউরিটিগুলোও সেরকম ছিল। আমি সিকিউরিটিদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আই কন্টাক্ট করে কাছে গেলাম। বললাম “আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আমাদের দেশে ম্যারাডোনার প্রচুর ফ্যান ফলোয়ার রয়েছে আমি ম্যারাডোনার কাছে গিয়ে কি একটু হাই-হ্যালো করতে পারি?" বাংলাদেশ শোনার পর মনে হলো যে সে রাজি। এরপর সে ম্যারাডোনার দিকে তাকালো সেই সময় আমিও সুযোগটা নিয়েছি। ম্যারাডোনার দিকে তাকিয়ে বলেছি "হাই দিয়েগো" তখন ম্যারাডোনা দূর থেকে তার সিকিউরিটিকে হাত ইশারা করে আমাকে ছেড়ে দিতে বললেন। '
'এই সবকিছু কিন্তু ২-৩ মিনিটের মধ্যেই ঘটে গেছে। এই যে লাইন ধরলাম, পরে সামনে এগিয়ে এসে সিকিউরিটি রাজি করালাম এবং পরে আমি তাকে গিয়ে বললাম "থ্যাংক ইউ দিয়েগো"। আমি আমার পরিচয়টা দিয়ে বললাম যে "আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি তোমার অনেক ফ্যান ফলোয়ার্স বাংলাদেশে অনেক পাগলামি করে, আমারা বিশ্বকাপের সময় পতাকা উড়িয়ে খেলা দেখি, তুমি কি এগুলো জানো?" তখন সে মাথা নাড়িয়া আমাকে বললেন "হ্যাঁ মিস্টার, বাংলাদেশে আমার শুভেচ্ছা পৌঁছে দিও ধন্যবাদ। " এবার আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমি কি আপনার সাথে একটা সেলফি তুলতে পারি। তখন সে আমাকে বললেন, “ইয়েস মিস্টার বাংলাদেশ” এরপর ছবি তুলে আমি চলে এসেছি। '
ম্যারাডোনার সঙ্গে আরও একবার দেখা হয়েছিল বাফুফের সাধারণ সম্পাদকের। তাকে সামনা সামনি দেখার শেষ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সোহাগ বলেন, ‘ফিফা সদস্যদের নিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালের সময় একটা লাঞ্চের শিডিউল ছিল। সেখানে আমি এক্সেস পেয়েছিলাম যাওয়ার। সেখানেই দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল ম্যারাডোনার সাথে, তবে সেখানে প্রথমদিনের মতো এত ভিড় ছিল না। আমি সরাসরিই তার কাছে গিয়ে বললাম “আই এম ফ্রম বাংলাদেশ, তোমার সাথে ওইদিন দেখা হয়েছিল। সে হেসে দিলেন, এরপর বললেন “ইয়েস ইয়েস” সে বললেও আমার মনে হয় না সে আমাকে চিনেছে। পরে আমি বললাম "হাউ আর ইউ?" সে আমাকে বললেন "ইয়েস গুড গুড" এরপর আমি তাকে জিজ্ঞাসে করলাম সে আমকে চিনতে পেরেছেন কিনা, সে মাথা নাড়ালেও মনে হলো চিনতে পারেননি। বাংলাদেশের কথা বলতেই আমাকে বললেন "গিভ মাই রিগার্ডস টু ইয়োর কান্ট্রি"। এটাই ছিল তার সাথে আমার শেষ দেখা। ’
দেশের ফুটবলের শীর্ষ এই কর্তাব্যক্তি মনে করেন, পুরো বিশ্বের ফুটবলের পরিবর্তনে ম্যারাডোনার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বিশ্ব ফুটবল এটা কোনো দিনও ভুলতে পারবে না।
তিনি বলেন, 'ফুটবলের বিশ্বায়নের জন্য, ফুটবলের জনপ্রিয়তার জন্য ম্যারাডোনা একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশ্বের কাছে ফুটবলটাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সেই আশির দশকে ফুটবল আস্তে আস্তে ব্র্যান্ডিং শুরু করলো। তখন ফুটবলের ব্যাবসায়িক দিক, জনপ্রিয়তার দিকে একটা পেশাদারিত্ব আসা শুরু করলো। টিভি রাইটস থেকে শুরু করে সবকিছু এসব কিছুর পেছনে নিঃসন্দেহে ম্যারাডোনার অবদান রয়েছে। '
এতকিছুর পরও বাস্তবতা এটাই যে ব্যক্তি ম্যারাডোনাকে আর দেখা যাবে না। তাই সবার চাওয়া ওই দূর আকাশ থেকে ফুটবল ঈশ্বর তার আশীর্বাদ ছড়িয়ে দেবে ফুটবল বিশ্বে।
বাংলাদেশ সময়: ২১২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০২০
আরএআর/এমএমএস