ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফুটবল

২০২২ কাতার বিশ্বকাপ/

কেমন হলো আর্জেন্টিনা দল, কোথায় শক্তি-দুর্বলতা

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২২
কেমন হলো আর্জেন্টিনা দল, কোথায় শক্তি-দুর্বলতা সংগৃহীত ছবি

কাতার বিশ্বকাপে সময়ের সেরা দল নিয়ে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা। ফেভারিটদের তালিকায়ও উপরের দিকে আছে তাদের নাম।

দলের সবচেয়ে বড় তারকা লিওনেল মেসির শেষ বিশ্বকাপ হতে পারে এটি, জয়ের তাড়নাও তাই আলবিসেলেস্তেদের একটু বেশিই। চলুন একনজরে দেখে আসি তাদের শক্তি-দুর্বলতা, সম্ভাব্য কৌশল-

দল কেমন হবে

গোলরক্ষক: আর্জেন্টিনার গোলবারের নিচে প্রথম পছন্দ কোনো সন্দেহ ছাড়াই এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। ২০২১ কোপা আমেরিকার ঠিক আগে দলে সুযোগ পাওয়া এই ফুটবলার নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ২৮ বছর পর বিশ্বকাপ জেতায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অ্যাস্টন ভিলার এই গোলরক্ষকের।

মার্তিনেজের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে- ব্যাকলাইনের সঙ্গে যোগাযোগটা দারুণ থাকে তার। সেট-পিসে ডিফেন্সকে সংগঠিত করা, শট ঠেকানো অথবা জায়গা থেকে বেরিয়ে দলকে রক্ষা করা; সব জায়গাতেই নিজের ছাপ রেখেছেন তিনি। জাতীয় দলের গোলবারের নিচে ভুল প্রায় করেনইনি মার্তিনেজ। বিশ্বকাপেও তাই তার ওপর ভরসা করবে দল।

ডিফেন্স: সেন্টার ব্যাক পজিশনে অভিজ্ঞ নিকোলাস ওতামেন্দির সঙ্গে থাকবেন তরুণ ক্রিস্তিয়ান রোমেরো। চলতি মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেওয়া লিসান্দ্রো মার্তিনেজও কোচ লিওনেল স্কালোনির হাতে বিকল্প হিসেবে থাকছেন। ক্লাবে দুর্দান্ত পারফর্ম করলেও শুরুর একাদশে তার থাকার সম্ভাবনা কম।

ফুল ব্যাক পজিশনে কিছুটা চিন্তার জায়গা আছে স্কালোনির জন্য। সম্ভবত তার পছন্দের শীর্ষে থাকবেন নিকোলাস তাগ্লিয়াফিকো ও নাহুয়েল মলিনা। দুজন আবার দুই ধরনের খেলেন, এটাও ভারসাম্য দেবে আর্জেন্টিনাকে।

তাগ্লিয়াফিকো আক্রমণে অবদান রাখতে পারেন। মাঠে তার উঠা-নামা দলকে সুবিধা দিয়ে থাকে। বিশেষত তাদের বক্সে লাউতারো মার্তিনেজের মতো ফিনিশার থাকায় তাগ্লিয়াফিকোর অবদান রাখার সুযোগ আরও বেশি।

এদিক থেকে আক্রমণে মলিনার অবদান থাকে কম। কিন্তু ট্যাকল করার সক্ষমতায় এগিয়ে তিনি। আক্রমণে উঠলেও দল বলের নিয়ন্ত্রণ হারালে দ্রুতই নিচে নেমে আসতে পারেন মলিনা। প্রতিপক্ষের কাউন্টার অ্যাটাকের সময় আর্জেন্টিনার যেটা কাজে আসবে বেশ।

মিডফিল্ড: এই জায়গায় জিওভান্নি লো সেলসোর না থাকা কোচ স্কালোনির জন্য বড় ধাক্কা। ভিয়ারিয়ালের হয়ে খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে ছিটকে গেছেন তিনি। গত কয়েক বছরে তার সঙ্গে মিডফিল্ডে লিয়ান্দ্রো পারেদেস ও রদ্রিগো দি পল ফিক্সড ছিলেন। দলের সবচেয়ে বড় তারকা লিওনেল মেসিকে বল যোগান দিতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন সেলসো।  

এসব নিয়ে ভেবে অবশ্য এখন আর স্কালোনির লাভ নেই তেমন। আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডের হৃদয় হিসেবে দি পল থাকবেন। ক্লাব আতলেতিকো মাদ্রিদে অবশ্য তার সময় ভালো যাচ্ছে না। বেশিরভাগ ম্যাচেই বসে থাকছেন বেঞ্চে। তবে জাতীয় দলের জার্সিতে একদম আলাদা পারফর্ম করেন দি পল। মাঠের মাঝখান থেকে আক্রমণের ভিত গড়ে দিতে পারেন। অনেক জায়গা নিয়ে খেলার সঙ্গে ডিফেন্স চেরা পাস দিতেও পারদর্শী তিনি।

দি পলের সঙ্গে লিয়ান্দ্রো পারেদেস ও এঞ্জো ফার্নান্দেসের শুরু করার সম্ভাবনা বেশি। পারেদেসের উপস্থিতি ফার্নান্দেসকে সাহস যোগাবে সামনে এগিয়ে যেতে। আক্রমণে তখন আর্জেন্টিনার ফুটবলারের সংখ্যাও বাড়বে। চলতি মৌসুমে বেনফিকার হয়ে তিন গোল ও চার অ্যাসিস্ট করা ফার্নান্দেসের জালটা ভালোই চেনা।

বেনফিকা তারকার জায়গায় খেলতে পারেন ব্রাইটনের ম্যাক অ্যালিস্টার। দুজনের খেলার ধরনই এক। এক্ষেত্রে আর্জেন্টিনা যদি ডিফেন্সে বাড়তি নজর দিতে চায়, তাহলে তাদের হাতে বিকল্প হিসেবে আছে গুইদো রদ্রিগেজ।

ফরোয়ার্ড: মাঠে আর্জেন্টিনার জন্য সবচেয়ে রোমাঞ্চকর জায়গা এটি। লিওনেল মেসি এই অংশের নেতা কোনো সন্দেহ ছাড়াই। কিন্তু স্কালোনি তার অধীন সময়ে ‘মেসি নির্ভরতা’ কমিয়ে দলের সবাইকে নিজস্বতা দেখানোর প্রতি জোর দিয়েছেন। তাতে তিনি সফলও হয়েছেন।

মেসি, দি মারিয়া ও মার্তিনেজের অ্যাটাকিং লাইন হতে পারে আর্জেন্টিনার বড় শক্তি। দুই উইংয়ে মেসি ও দি মারিয়া থাকার মানে হচ্ছে, মাঝে দাঁড়ানো মার্তিনেজের কাছে অনেক বল আসবে। তার গোল করতে পারা বা না পারার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে আর্জেন্টিনার এগিয়ে চলা।  

মেসি এখন নিজেকে বদলে ফেলেছেন। প্লে মেকারের ভূমিকাতেই এখন বেশি দেখা যায় তাকে। চলতি মৌসুমে পিএসজির হয়ে ১৪ অ্যাসিস্ট প্রমাণ দেয় তার। তবে মেসির গোল করতে পারার ক্ষমতা নিয়েও নিশ্চয়ই সংশয় নেই কারও।

এক্ষেত্রে মার্তিনেজের কাজ হবে তার দুই উইংয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। তাকে পাহাড়ায় রাখা ফুটবলারকে ফাঁকি দিয়ে গোল করার ক্ষমতা মার্তিনেজের আছে। বক্সের ভেতর তিনি বিপজ্জনক সবসময়। মার্তিনেজের বিকল্প হিসেবে থাকবেন হুলিয়ান আলভারেজ।

দি মারিয়ার নিজেকে প্রমাণ করার কিছু নেই। হুট করে গোল করতে পারার ক্ষমতা তো তার আছেই। সঙ্গে ‘বিগ ম্যাচ প্লেয়ার’ তকমাও। আলবিসেলেস্তেদের প্রার্থনা থাকতে পারে কেবল মারিয়ার সুস্থ থাকার।

তাহলে ফরম্যাশন কেমন হবে?

৪-৩-৩

সাধারণভাবে এটাই হবে আর্জেন্টিনার ফরম্যাশন। বল পায়ে অথবা বল ছাড়া এতে কিছুটা পরিবর্তনও আসতে পারে। কখনও কখনও মার্তিনেসকে সামনে রেখে হয়ে যেতে পারে ৪-৪-১। দলের টার্গেট ম্যান হিসেবে ইন্টার মিলান তারকা থাকবেন। দুই ফুলব্যাক থাকবেন কিছুটা আক্রমণাত্মক। একাদশ হতে পারে এমন-

মার্তিনেস (গোলরক্ষক)
মলিনা, ওতামেন্দি, রোমেরো, টাগ্লিয়াফিকো
পারেদেস, দি পল, ফার্নান্দেস
দি মারিয়া, মেসি, মার্তিনেস

দল গড়ার পেছনের পরিকল্পনা

আর্জেন্টিনা এবার বেশ রোমাঞ্চকর এক দল নিয়ে যাচ্ছে বিশ্বকাপে। স্কালোনির শিষ্যদের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে- একতা। গত চার বছর ধরে তারা প্রমাণ করেছেন- মাঠে একে-অন্যের জন্য নিজেকে উজাড় করতে দ্বিধা নেই তাদের। একাদশ, এমনকি স্কোয়াডের সবাইও নিজেদের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন। এক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন স্কালোনি।

রাশিয়া বিশ্বকাপের শেষ ষোলো থেকে ছিটকে যাওয়া, দলের ভেতরে-বাইরে প্রবল সংকটের পর কোচের দায়িত্বে ছেড়েছিলেন হোর্হে সাম্পাওলি। এরপর স্কালোনি সঙ্গী হিসেবে পাবলো আইমারকে নিয়ে ভাঙাচোরা দলকে গড়েছেন নিজের মতো করে।  

শুরুতে অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব পাওয়ার পর স্কালোনির চুক্তি বাড়ানো হয় ২০১৯ কোপা আমেরিকা অবধি। তৃতীয় হয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করে আর্জেন্টিনা। এরপর পরের কোপা ও বিশ্বকাপ অবধি চুক্তি বাড়ে তার।

স্কালোনির অধীনে আর্জেন্টিনা সবসময় ভালো পারফরম্যান্স করেছে, ব্যাপারটা এমন না। শুরুর দিকে আলবিসেলেস্তেদের দেখে মনে হয়েছে, কী করতে হবে জানা নেই তাদের, দ্বিধাও দেখা গেছে নানারকম। তবে ধীরে ধীরে গুছিয়ে নিয়ে ‘দল’ হিসেবে নিজেদের চেনাতে পেরেছে তারা।

দায়িত্ব নেওয়ার পর দল থেকে কিছু ‘বুড়ো’ ফুটবলার বাদ দেন স্কালোনি। নিজের মতো করে গড়েন দল। ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থেকে তার সিদ্ধান্তের যথার্থতাও প্রমাণ করে আর্জেন্টিনা। রবার্তো মানচিনির ইতালির ৩৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভাঙার চেয়ে এখন কেবল দুই ম্যাচ দূরে আলবিসেলেস্তেরা।  

দলের মধ্যে অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন স্কালোনি। এর সঙ্গে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার মেসির থাকা বাড়তি পাওয়া তাদের। দলের সবাই তাদের অধিনায়কের জন্য ‘জীবন দিতে প্রস্তুত’ থাকেন, এটাও বেশ শক্তি যোগাবে আর্জেন্টিনাকে।

কোচ

ফুটবলার হিসেবে তেমন বড় নাম ছিলেন না স্কালোনি। কোচিংয়েও সাম্পাওলির সহকারী ছাড়া তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। শুরুর দিকে এ নিয়ে কম সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি। তবে স্কালোনি ধৈর্য ধরেছেন, বিশ্বাস রেখেছেন তার খেলোয়াড়ী জীবনের বন্ধুদের ওপর।  

আইমার, রবার্তো আয়লা ও ওয়ালতার সাম্যুয়েলকে নিজের কোচিং প্যানেলের অংশ বানিয়েছেন। এরপর কোপা আমেরিকা জিতিয়ে আর্জেন্টিনা ও দলের সবচেয়ে বড় তারকা মেসির মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। এরপর থেকে সমালোচনা তো দূর, এখন সমর্থকদের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতেই আছেন স্কালোনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২২
এমএইচবি/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।