শুক্রবার (৩০ মার্চ) সকালে ইছামতির তীরে গড়ে তোলা ছোট কিন্তু সুন্দর ‘আবেগে ভর’ করে গড়ে তোলা পর্যটন কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন রতন ঘোষ। পেশায় শিক্ষক তিনি।
টাকি কিংবা হাসনাবাদ। বাংলাদেশিদের কাছে পশ্চিমবাংলার অতি পরিচিত দুটি জায়গার নাম। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল টাকি। দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে ভারতে যারা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলেন তাদের অন্যতম রুট ছিল এটি। ক্যাম্পও ছিল এখানে। ওপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা থানার টাউন শ্রীপুর। নদীতীরের একটি অংশকে টাকি নামেও ডাকা হয়। মাঝে নিশ্বাস ফেলে ইছামতি নদী।
ভারতে বাংলাদেশের বর্ডার ডেলিগেটস টিমের দ্বিতীয় দিনের রাত্রিযাপন হয় ইছামতির তীরের একটি গেস্ট হাউসে। ছাদ থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের গাছগাছালি, কিংবা দু’একটি বাড়িঘর। আর সকাল কিংবা সাঁঝে ওপার থেকে উড়ে আসা ধবল বকদলের তো কোনো সীমানা নেই। তারাই হয়তো ওড়ায় সৌহার্দ্যের বার্তা।
উত্তর চব্বিশ পরগনার টাকি একটি পৌরসভা। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য হাসনাবাদ থেকে সরাসরি ট্রেন কিংবা বসিরহাট থেকে বাস। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এ মহকুমায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে বেশিদিন হয়নি। যতটুকু উন্নয়ন তার জন্য ভূমিকা রয়েছে ‘বাংলাদেশের প্রতি আবেগ’। বাংলাদেশ সীমান্ত ভারতের অনেক জায়গা থেকে দেখা গেলেও এখান থেকে দেখার পরিবেশটা যেন অন্যরকম। ঐতিহাসিকভাবেও জায়গাটির গুরুত্ব হয়তো একটি বিষয়।
যখন দুই দেশের সীমান্তের বাধা ছিল না তখন মানুষ এখান থেকে নদী পার হতো। যেটা মুক্তিযুদ্ধের সময় হয়ে উঠেছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের মোবাইল নেটওয়ার্ক ভালোমতো কাজ না করলেও বাংলাদেশের সিমে কথা বলা যায় বেশ স্পষ্ট।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন এখানে বাংলাদেশ দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় জমাতো। এসব দেখে পৌরসভা ৬-৭ বছর আগে টাকি পোস্ট অফিস সংলগ্ন আধা কিলোমিটারের বেশি জায়গা পর্যটকদের উপযোগী করে আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলেছে। রয়েছে বসার সুদৃশ্য জায়গা। একটি ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করেছে বিএসএফ। এতে উঠে বাংলাদেশের সীমান্ত আরো ভালোভাবে দেখা যায়।
এখানে কেন, কারা আসে? এ প্রশ্নে অবাক হয়ে যান স্থানীয় দোকানি বিমল। বলেন, আসবে না কেন, এখান থেকে বাংলাদেশের সীমান্তের ওপার দেখা যায়। এখান প্রচুর মানুষের আত্মীয়-স্বজন আছে ওপাড়ে। তাছাড়া কলকাতার পাশাপাশি বাইরের জেলা কিংবা প্রদেশ থেকেও অনেকে আসে। শীতের সময় সিজনে এখানে দাঁড়ানোর জায়গা পাবেন না। আর আশপাশে তেমন কিছু দেখার নেই বাংলাদেশ ছাড়া।
বাঁধানো নদীর পাড়ে বসে সীমান্ত দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে পৌরসভা। সারি সারি সুদৃশ্য বেঞ্চ। বেঞ্চের পেছনে লাগানো হয়েছে বকুল গাছ। সকালে ঝরে পড়ে থাকে আর সন্ধ্যায় মাতাল করা গন্ধ ছড়ায়। বকুল ফুলের সঙ্গে যে স্মৃতিটুকুও ডুকরে ওঠে!
নদীর ঘাটে নৌকা রয়েছে। চাইলে পর্যটকরা ভাড়া করে ঘুরতে পারবেন। গড়ে উঠেছে বেশকিছু ভালোমানের লজ, আবাসিক হোটেল। চাইলে একেবারে তীরঘেঁষে থাকার সুযোগ রয়েছে। ৪৭ কিংবা ৭১, অনেকে ছেড়েছেন দেশ। কিন্তু দুদেশে রয়ে গেছে তাদের আত্মীয়-স্বজন। অনেকে সেই স্মৃতি খুঁড়ে বেদনা জাগাতেও হয়তো আসেন এখানে।
ওপার থেকে ভেসে আসা বাংলার বাতাস হয়তো বয়ে আনে এখনও পুরনো স্মৃতি-সুধা-গন্ধ। বাংলাদেশ এখানে এক আবেগের নাম। বিদায় নেওয়ার সময় টাকি ঘাটে জড়ো হওয়া মানুষগুলো যেন সেই বারতাই দিচ্ছিলো।
এখান থেকে বাঘ দেখা যায়!
বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৮
এএ/এমজেএফ