মাস্টার দা’র পরিকল্পনায় ৯ জন বিপ্লবীর একটি দল গঠন হয়। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর গঠিত এ দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পাহাড়তলীর সেই ক্লাবটি আক্রমণের।
ইউরোপিয়ান ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। আর এর পাশ দিয়েই ওই ক্লাবে যেতে হবে। কিন্তু নেত্রী প্রীতিলতা যাবেন কিভাবে? ধরলেন পুরুষ পাঞ্জাবীর বেশ। পরনে ধুতি, পাঞ্জাবি আর মাথায় পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতো।
রাত ১০টা ৪৫ মিনিট। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেন। প্রায় ৪০ জন ব্রিটিশ তখন ক্লাব ঘরে মদ্যপ অবস্থায়। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করে। মুহুর্মুহু গুলি আর বোমার আঘাতে ক্লাবটা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ক্লাবের সব বাতি নিভে যায়। অন্ধকারে সবাই ছোটাছুটি করতে লাগলো। কয়েকজন ইংরেজের কাছে রিভলবার ছিল। তারা পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকলো। একজনের রিভলবারের গুলি প্রীতিলতার বাঁ পাশে আঘাত করে। এরপর প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হয়। ফেরার পথে প্রীতিলতা লুটিয়ে পড়েন। অন্যদের নিরাপদে ফেরত পাঠিয়ে তিনি ধরা পড়ার আগেই সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
রিপোর্ট অনুযায়ী, সেদিনের ওই আক্রমণে একজন নিহত হয় এবং ১১ জন আহত হয়। তবে মিশনে অংশ নেওয়া বিপ্লবীদের কথায় প্রাণহানির সংখ্যাটা অনেক ছিল। তবে প্রীতিলতা এই অতর্কিত সাহসী আক্রমণই সেদিনের পর থেকে ব্রিটিশ শাসকদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।
১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে জন্ম নেওয়া প্রীতিলতার শাহাদত বরণের সময় বয়স হয়েছিল মাত্র ২১ বছর ৪ মাস। মাস্টার দা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শোষক গোষ্ঠী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এই প্রীতিলতাই ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম নারী শহীদ।
ভারতবাসীর স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবে আত্মনিয়োগ করলেও শিক্ষাজীবনেও তুখোড় মেধাবী ছিলেন প্রীতিলতা। চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাসের পর ১৯৩০ সালে তিনি ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট (আইএ) পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হন। এরপর কলকাতা বেথুন কলেজে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত) বিএ শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। এখানে তার অন্যতম বিষয় ছিল দর্শন। দর্শনের পরীক্ষায় প্রীতিলতা সবার চেয়ে ভালো ফলাফল করতেন। এই বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় সেই ইচ্ছা পূরণ হতে পারেনি। তবে ১৯৩২ সালের ২৩ মার্চে ডিসটিংশন নিয়ে বিএ পাশ করেন এই মেধাবী বীরকন্যা।
সেই ডিসটিংশন সার্টিফিকেট ও ফলাফলের কাগজ কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের সহযোগিতায় হাতে এলো এই বৃহস্পতিবার (২৬ জুলাই)। প্রীতিলতার শাহাদত বরণের প্রায় ৮৬ বছর পর। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন মাথায় চেপে বসলেও প্রীতিলতা পড়াশোনায় কতোটা মেধাবী ছিলেন তা তার ফলাফলই বলে দিচ্ছে।
প্রীতিলতার ডিসটিংশনসহ বিএ পাসের সেই সার্টিফিকেট ও ফলাফলের কাগজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ভাইস চ্যান্সেলর সোনালী চক্রবর্তী বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের প্রেস সচিব ড. মো. মোফাকখারুল ইকবাল ও হেড অব চ্যান্সেরি বি এম জামাল হোসেনের হাতে তুলে দেন।
অনুষ্ঠানে মোফাকখারুল ইকবাল বলেন, এ বিষয়ে আমরা অনেকদিন ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। আমি নস্টালজিক হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারছি না তার সেই ডিসটিংশন সার্টিফিকেট আমি নিতে এসেছি।
একই ভাবনায় জামাল হোসেন বলেন, আমরা গর্বিত ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণের সাক্ষী হতে পেরে। গুরুত্বের সঙ্গে এ সার্টিফিকেট ও কাগজ যথাস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৮
ভিএস/এইচএ/