ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ইউক্রেনে ক্লাস্টার বোমা পাঠানোর পক্ষে-বিপক্ষে যত সাফাই

মোহাম্মদ নাহিয়ান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০২৩
ইউক্রেনে ক্লাস্টার বোমা পাঠানোর পক্ষে-বিপক্ষে যত সাফাই

বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বোমার ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও ইউক্রেনে এই বোমা পাঠানোর ‘কঠিন সিদ্ধান্তের’ পক্ষে সাফাই গেয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।  

যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তে ইতোমধ্যেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিশ্বব্যাপী।

মানবাধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশ আমেরিকার এমন সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছে।  

ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বোমা হলো একটি বড় বোমার মধ্যে অসংখ্য ছোট ছোট বোমা (বম্বলেট), যা বৃহৎ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে। এক্ষেত্রে যুদ্ধে মূলত রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র বা কামান থেকে প্রচুর পরিমাণে ছোট ছোট বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এভাবে একটি বিস্তৃত এলাকায় ছোট ছোট বোমা ছড়িয়ে দেওয়া যায়।  

অনেক ক্ষেত্রে ক্লাস্টার বোমার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরিত হয় না, যে অংশটিকে বলা হয়-‘ডাডস’। ভেজা বা নরম মাটিতে যেসব বোমা ছড়ায়, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বিস্ফোরিত না হয়ে পরে বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ভুক্তভোগী পঙ্গু হওয়াসহ মারাত্মকভাবে আহত কিংবা নিহত হতে পারেন।  

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে, ১৯৬৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত গুচ্ছ বোমার আঘাতে লাখ খানেক মানুষ নিহত হয়েছেন কিংবা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। হতাহতদের ৯৮ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক। অবিস্ফোরিত বোমার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পর পর্যন্তও বিস্ফোরণ ঘটার ঝুঁকি থাকে। আর এর সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা। মাটিতে পড়ে থাকা ছোট বোমাকে খেলনা ভেবে এর ভয়াবহতার শিকার হয়েছে অসংখ্য শিশু।

বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ক্লাস্টার অস্ত্রের ব্যবহারকে ‘ঘৃণ্য’ এবং এমনকি ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবেও বর্ণনা করেছে।  

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ক্লাস্টার বিস্ফোরক ‘সংঘাত শেষ হওয়ার অনেক সময় পরও বেসামরিক মানুষের জীবনের জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়ে থাকে’।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়াশিংটনের পরিচালক সারাহ ইয়াগার মার্কিন এই পদক্ষেপকে ‘বিধ্বংসী’ বলে অভিহিত করেছেন। আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সারাহ ইয়াগার বলেছেন, ‘এসব বোমা বেসামরিক নাগরিকদের জন্য একেবারেই ভয়ঙ্কর। ’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কারণ ‘ইউক্রেনের গোলাবারুদ ফুরিয়ে’ আসছে। এ কারণে তিনি ‘পরিস্থিতির বিবেচনা’ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এরই মাঝে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও স্পেন বলেছে যে, তারা এ অস্ত্র ব্যবহারের বিরোধী এবং জাতিসংঘও এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্রবিষয়ক কনভেনশনে সই করা ১২৩টি দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্য একটি, তারা এ জাতীয় অস্ত্র উৎপাদন বা ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে এবং অস্ত্রটি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেছে।

কানাডা সরকার বলেছে, তারা শিশুদের ওপর এই বোমার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন– বিশেষ করে যেসব বোমা কখনও কখনও বহু বছর ধরে অবিস্ফোরিত থাকে।

‘আমরা কনভেনশনের দেওয়া শর্তগুলোকে গুরুত্ব সহকারে মেনে চলি এবং সবাই যেন তাই করে সেজন্য উৎসাহিত করি,’ এক বিবৃতিতে দেশটি জানিয়েছে।

স্পেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্গারিটা রবলেস সাংবাদিকদের বলেন, তার দেশের ‘দৃঢ় অবস্থান’ ছিল যে, এ ধরনের অস্ত্র ও বোমা ইউক্রেনে পাঠানো যাবে না।

তিনি আরও বলেন, ‘ক্লাস্টার বোমাকে না এবং ইউক্রেনের বৈধ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে হ্যাঁ, যা ক্লাস্টার বোমা দিয়ে নিশ্চিত করা উচিত নয়। ’

ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, ‘ক্লাস্টার বোমার ক্ষেত্রে সামরিক জোট কোনো অবস্থান নেয়নি। ’

ইউক্রেনকে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা দেওয়ার পূর্ব এশিয়ার দেশ চীন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ইউক্রেন যুদ্ধে ‘মানবিক সমস্যা’ দেখা দিতে পারে, এমন ধারণা করছে দেশটি। সম্প্রতি বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং।  

মার্কিন সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে পুরো বিশ্বে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বলে জানান তিনি। মাও আরও বলেন, ‘চীন সরকার বিশ্বাস করে, উত্তেজনা ও ইউক্রেনের সংকট যাতে বাড়তে না পারে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষের উচিত আগুনে ঘি ঢালা থেকে বিরত থাকা। ’

তবে ইউক্রেনকে ক্লাস্টার বোমা দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে কিয়েভ। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ বলেছেন, ‘তার দেশের ভূখণ্ড দখলমুক্ত করতে এই অস্ত্র সহায়তা করবে। ’ তিনি অঙ্গীকার করেন, ‘কিয়েভ এই অস্ত্র রাশিয়ার ভূখণ্ডে ব্যবহার করবে না। ’ তবে এই অস্ত্র তার দেশের সেনাদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে বলে দাবি করেন তিনি।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইউক্রেন সংঘাত দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে কিয়েভ সরকারকে ক্লাস্টার বোমা সরবরাহ করার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত একটি আগ্রাসী নীতির উদাহরণ। ’

ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট সদস্য বারবারা লি জো বাইডেনের সিদ্ধান্তকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেন। মিনেসোটার ডেমোক্র্যাট সদস্য বেটি ম্যাককোলাম বলেন, এটি ‘ভয়ংকর ভুল’ হবে।

ম্যাসাচুসেটসের আরেক ডেমোক্র্যাট সদস্য ম্যাক গোভার্ন বলেন, ‘সংঘাত শেষ হয়ে গেলেও’ এ ধরনের দীর্ঘদিন অবিস্ফোরিত বোমা বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বিরাট ঝুঁকির।

ইউএস ক্লাস্টার মিউনিশন কোয়ালিশন, যা অস্ত্র নির্মূলবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজের প্রচারণার অংশ, এটি বলছে, এই সিদ্ধান্ত ‘আজ এবং আগামী কয়েক দশকের জন্য বড় ধরনের দুর্ভোগ বয়ে আনবে’।

মানব সভ্যতার জন্য ঝুঁকি এবং এর ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে ২০০৮ সালে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে ক্লাস্টার বোমা নিষিদ্ধ করা হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে ক্লাস্টার বোমা উৎপাদন, পরিবহন, মজুত ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও রাশিয়া ওই চুক্তিতে সই করেনি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধেও এই বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।  

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা
এমএন/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।