ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

আল জাজিরার বিশ্লেষণ: 

হামাস কি ইসরায়েলের কল্পনার চেয়েও অত্যাধুনিক?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০২৩
হামাস কি ইসরায়েলের কল্পনার চেয়েও অত্যাধুনিক?

ইসরায়েলের অপ্রতিরোধ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে গত শনিবারের হামলায় হামাস যে কৌশল ব্যবহার করেছে, তা এখন পর্যন্ত তাদের সবচেয়ে অত্যাধুনিক কৌশল। এ কারণে বিভিন্ন মহল থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, হামাস কি ইসরায়েলের চেয়ে অত্যাধুনিক কৌশল রপ্ত করে ফেলেছে?

হামাস তাদের হামলায় আকাশ, সমুদ্র এবং স্থলপথ ব্যবহার করে, যা সামরিক পরিভাষায় মাল্টি-ডোমেন অপারেশন হিসেবে পরিচিত।

ইসরায়েলি ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক রকেট হামলার আগে ড্রোন ব্যবহার করে তাদের পর্যবেক্ষণ চৌকিতে প্রাথমিক হামলা চালিয়েছিল তারা।

এগুলোকে শেপিং অপারেশন বলা হয়, যা ছিল ইসরায়েলের মাটিতে হামাস সদস্যদের প্রবেশের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি।

এরপরের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। ইসরায়েলে প্রবেশ করে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়, ইসরায়েলি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে সৈন্যদের হত্যা ও আটক করা হয়। একইসঙ্গে সামরিক সরঞ্জাম দখল করা হয়।

এসব কার্যক্রমের পেছনে মনস্তাত্ত্বিক উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে ইসরায়েলি সীমান্ত এলাকায় আক্রমণ রেকর্ড করে সম্প্রচার করা, একটি সংগীত কনসার্টের পাশাপাশি ইসরায়েলি সৈন্য এবং বেসামরিক নাগরিকদের আটক করে তাদের গাজা উপত্যকায় নিয়ে আসা।  

গোপন পরিকল্পনা
হামাস এমন এক সময় এ হামলার পরিকল্পনা করে যখন ইসরায়েলে কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক উত্তেজনা চলছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকার বেশকিছু আইন উত্থাপন করে যা বিচার বিভাগকে দুর্বল করে দিতে পারে। এ নিয়ে বিরোধীরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিল।

এইসব ‘ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ’- এর আড়ালে হামাস তাদের পরিকল্পনা সাজায়।

সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, হামাস সুড়ঙ্গ অবকাঠামোতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ইসরায়েলি চেকপয়েন্টগুলো অতিক্রম করে আচমকা আক্রমণ চালানোর জন্য তারা ভূগর্ভস্থ পথগুলোর একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।  

হামাস বিভিন্ন উৎস থেকে শিক্ষা নিয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে অতীতের সংঘর্ষ থেকে শিক্ষা নিয়েছে, ২০০২ সালে জেনিনে যোদ্ধাদের দ্বারা ব্যবহৃত কৌশলগুলো অধ্যয়ন করেছে এবং তার সঙ্গে যোগ করেছে তাদের নিজস্ব কৌশলগুলোও।  

তারা হিজবুল্লাহর সামরিক অবকাঠামো এবং বিদ্রোহীদের যুদ্ধকৌশল থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছে বলে মনে করা হয়।

ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে অতীতের সংঘর্ষ, বিশেষ করে ২০১৪ সালে গাজায় হামলার সময় হামাসকে শহুরে যুদ্ধের মূল্য এবং কীভাবে ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি), টানেল নেটওয়ার্ক, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ যুদ্ধের সর্বাধিক ব্যবহার করতে হয় তা শিখিয়েছে।

জেনিন পাঠ
হামাস ২০০২ সালে জেনিনের যুদ্ধের সময় জেনিন যোদ্ধাদের দ্বারা ব্যবহৃত কৌশলগুলো থেকে সুনির্দিষ্ট অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেছে বলে মনে হয়, যা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ২০০২ সালের এপ্রিলে জেনিন শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় নারী ও শিশুসহ কমপক্ষে ৫২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। এতে ২৩ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়।

জেনিনের যুদ্ধ থেকে হামাস যে মূল শিক্ষাটি নিয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো হতাহতের ঘটনা এবং ইসরায়েলি সামরিক অভিযানকে ব্যাহত করার ক্ষেত্রে আইইডিগুলোর কার্যকারিতা। আইইডিগুলো কম খরচে এবং সহজেই লুকিয়ে রাখা যায়, এগুলো অসম যুদ্ধের জন্য একটি মূল্যবান সরঞ্জাম। এরপর থেকে হামাস তাদের অস্ত্রাগারে আইইডি অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং ইসরায়েলি সামরিক যানবাহন, টহল এবং স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।

ইসরায়েল যদি গাজায় স্থল আক্রমণ শুরু করে, তাহলে অবশ্যই হামাসের এই কৌশলগুলো ব্যবহার আমরা দেখতে পাব।  

জেনিন যোদ্ধাদের কাছ থেকে আরেকটি সম্ভাব্য শিক্ষা ছিল কৌশলগত গতিশীলতা এবং বিস্ময়ের গুরুত্ব, যোদ্ধা এবং সরবরাহ সরানোর জন্য সুড়ঙ্গগুলোর একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা, ইসরায়েলি বাহিনীকে এড়ানো এবং আকস্মিক আক্রমণ চালানো।

কিন্তু সবমেষ কথা হলো, হামাস এমন একটি সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে যার অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং বিমান শক্তি রয়েছে। এই অস্ত্রের মুখে হামাসের কাছে ঘরে তৈরি আইইডি, রকেট এবং হালকা অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই নেই।  

এ কারণেই গোষ্ঠীটি কৌশলের ওপর নির্ভর করবে সবচেয়ে বেশি। সরাসরি সংঘর্ষে না গিয়ে হিট-অ্যান্ড-রান আক্রমণ এবং স্নাইপার ফায়ারের কৌশল ব্যবহার করে নিজেদের সদস্যদের হতাহতের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালাবে।  

কিন্তু এখন পর্যন্ত যা স্পষ্ট নয় তা হলো, হামাস এই সর্বশেষ হামলা থেকে কী আশা করছে। কারণ ওই অঞ্চল থেকে হামাসের বৃহত্তর সামরিক সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এবং ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আলোচনার জন্য ইতিমধ্যে থমকে যাওয়া কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় এর প্রভাব কী হবে তা দেখার বিষয়।

এখন যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো- গাজার নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকরা দুর্ভোগ পোহাবে, যারা আকাশপথে ভয়াবহ অভিযানের শিকার হচ্ছে। তাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, শিগগিরই স্থলপথেও আক্রমণ শুরু করবে ইসরায়েল।  

অন্যদিকে ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকরাও ভুগছে, কারণ সেখানে শত শত মৃত্যুর শোক তাদের সইতে হচ্ছে এবং নিখোঁজদের সন্ধানে মরিয়া হয়ে অনুসন্ধান চালাতে হচ্ছে।  

তাই প্রশ্ন জাগছে, হামাসের অপারেশনাল বিস্ময় কি কৌশলগত ক্ষতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে? এটা এখন শুধু সময় এবং আরও রক্তক্ষয়ই বলে দেবে।  

বাংলাদেশ সময়: ২১০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০২৩
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।