যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের নানা কেলেঙ্কারির খবর সামনে আসছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই তার একের পর এক অপকর্মের অভিযোগ থলে থেকে বেরোচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতেও টিউলিপের অবস্থান নড়বড়ে হতে শুরু করেছে, পাশাপাশি সরকারেও। বিরোধী দল থেকে তার পদত্যাগের প্রস্তাবও উঠছে। এরইমধ্যে লেবার পার্টি টিউলিপের বিকল্প খোঁজা শুরু করেছে বলেও খবর এসেছে।
টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের লেবার মন্ত্রিসভার সদস্য, তিনি ইকোনমিক সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার কাজ যুক্তরাজ্যের অর্থবাজারের ভেতরের দুর্নীতি সামলানো। তিনি বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে।
বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প থেকে টিউলিপের পরিবার ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সেই-সংক্রান্ত তদন্তে তার নাম এসেছে। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ তদন্ত করছে।
বাংলাদেশে ৯ প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে টিউলিপ সিদ্দিক, তার খালা শেখ হাসিনা, মা শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক।
এরইমধ্যে শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানাসহ তাদের পরিবারের সব সদস্যের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করা করেছে। শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক (ববি), দুই মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তির হিসাবের তথ্যও চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়েছে। এক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালাসংশ্লিষ্ট ধারা প্রযোজ্য হবে।
এর বাইরে ফ্ল্যাট বিতর্কেও জড়িয়েছেন ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডনে তাকে একটি ফ্ল্যাট দেন আবদুল মোতালিফ নামের একজন আবাসন ব্যবসায়ী। তবে ওই ফ্ল্যাটের বিনিময়ে কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয়নি। ওই ব্যবসায়ী ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ। বিনামূল্যে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের তথ্য মিলেছে যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধনসংক্রান্ত নথিপত্রে।
আবদুল মোতালিফ ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের কাছে কিংস ক্রসের ওই ফ্ল্যাট কেনার কথা স্বীকার করেছেন। তবে পরে সেটি নিয়ে কী করেছেন, তা নিয়ে কিছু বলতে চাননি। টিউলিপের ওই ফ্ল্যাট পাওয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতার খবর ‘ভুল’ বলে দাবি করেন টিউলিপের একজন মুখপাত্র।
এদিকে সানডে টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপ সিদ্দিক উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড এলাকায় এমন একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন, যেটি তার পরিবার পায় খালা শেখ হাসিনার এক ঘনিষ্ঠজনের কাছ থেকে। হ্যাম্পস্টেডের ফিঞ্চলে রোডের ওই ফ্ল্যাট টিউলিপের বোন রূপন্তিকে তার টিনেজ বয়সে বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছিল। সেজন্য তখন রূপন্তি ফ্ল্যাটটি তার বোনকে দিয়ে দেন।
টিউলিপের লন্ডনের ফ্ল্যাট নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমারের নৈতিক মানদণ্ডবিষয়ক উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাসের কাছে এ বিষয়ে তদন্ত চালানোর দাবি জানানো হয়। মন্ত্রীদের আচার-আচরণ, নীতি-নৈতিকতা বিষয়ে ম্যাগনাস যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
টিউলিপ তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে ম্যাগনাসের কাছে চিঠি (রেফারেল) লিখেছেন। রেফারেলে টিউলিপ বলেছেন, তার অবস্থান স্পষ্ট যে তিনি অন্যায় কিছু করেননি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট এরই মধ্যে নিশ্চিত করেছে যে ম্যাগনাস এখন আরও তদন্তসহ আরও পদক্ষেপের প্রয়োজন কি না, তা নির্ধারণে একটি ‘তথ্য অনুসন্ধান’ পরিচালনা করবেন।
এমন পরিস্থিতিতে টোরি এমপিরা টিউলিপের পদত্যাগ চাচ্ছেন। কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ব্যাডেনোচ তার এক্স পোস্টে বলেছেন, যুক্তরাজ্য সরকার যে আর্থিক সমস্যা তৈরি করেছে, তা মোকাবিলায় যখন মনোযোগী হওয়া উচিত, তখন টিউলিপ মনোযোগ নষ্টের কারণ হয়ে উঠেছেন। এখন বাংলাদেশ সরকার শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে টিউলিপের যোগসূত্র নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) রোববার দেওয়া এক পোস্টে ব্যাডেনোচ বলেন, মন্ত্রী টিউলিপকে বরখাস্ত করার সময় এসেছে কিয়ার স্টারমারের। নিজের ব্যক্তিগত বন্ধুকে (টিউলিপ) দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ তিনি (টিউলিপ) নিজেই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত।
এর আগে হ্যারো ইস্টের টোরি এমপি বব ব্ল্যাকম্যান বলেছিলেন, টিউলিপ সিদ্দিককে তার সম্পত্তি লেনদেনের বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে এবং মূলত কী বলা হয়েছিল এবং কেন, তা ব্যাখ্যা করতে হবে। যদি তিনি তা না করেন, তবে মন্ত্রী হিসেবে তার আর টিকে থাকা সম্ভব নয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছায়ামন্ত্রী ম্যাট ভাইকার্স বলেন, সরকারের যেকোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ অগ্রহণযোগ্য। তবে এটি আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয় যখন তিনি স্টারমারের দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী।
হান্টিংডনের টোরি এমপি নেন ওবেজ-জেকটি বলেন, টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্কে এই নতুন তথ্য উদ্বেগজনক। এখন এটি প্রমাণিত হয়েছে যে ফ্ল্যাটটি তিনি নিজে কেনেননি, বরং তাকে উপহার দেওয়া হয়েছে, তার আরও প্রশ্নের জবাব দেওয়া প্রয়োজন।
এতসব অভিযোগের মধ্যেই টিউলিপকে নিয়ে নতুন খবর সামনে এলো। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপের দুটি ম্যাচ তিনি স্টেডিয়ামে বসেই বিনামূল্যে উপভোগ করেন। সঙ্গে তার ভাই-বোনও ছিলেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের একজন সংসদ সদস্য তাদের সঙ্গে ছিলেন।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের খবরে এসব জানানো হয়েছে। সরকারি নথিপত্রের বরাতে খবরে বলা হয়েছে, দুপুরের খাবারসহ প্রতিটি ম্যাচের টিকিটের দাম ছিল ৩৫৮ দশমিক ৮০ পাউন্ড (প্রায় সাড়ে ৫৩ হাজার টাকা)।
টেলিগ্রাফের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে স্টারমারের হয়ে প্রচারণা চালান আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার নেতা–কর্মীরা। দেশটিতে আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়িতে টিউলিপের বসবাস নিয়েও বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগ করতে বাধ্য হলে দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে, সেই সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা করেছে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
ডাউনিং স্ট্রিটের সূত্র দ্য টাইমসকে জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও কে টিউলিপের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন, তা বিবেচনা করছেন।
তবে ডাউনিং স্ট্রিটের এক মুখপাত্র বলেন, যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দল টিউলিপের পদে বিকল্প ব্যক্তিদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করেছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা ‘পুরোপুরি অসত্য’।
প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এর আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মন্ত্রী টিউলিপের ওপর তার আস্থা আছে। টিউলিপ নিজে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানিয়ে সঠিক কাজ করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
আরএইচ