রাত ১টার পর ফাঁকা রাজপথের এদিক-সেদিক ঘুরে আমরা এসে পৌঁছলাম কাকরাইল মসজিদের গেটে। ততোক্ষণে ঢাকা হয়ে গেছে ঘুমের নগরী।
মসজিদের এপাশ ওপাশ ঘুরে দেখলাম। মসজিদের ভেতরে আলো নিভে গেলেও, সিঁড়ি, অজুখানা ও বাথরুমে লাইট জ্বলছে। লোকজনের আনাগোনাও আছে। কেউ বাথরুমে, কেউ হাউজ পাড়ে। কেউ ঘুমাচ্ছে। কেউ নামাজ পড়ছে। কেউ জিকির করছে।
মসজিদের সামনের ফাঁকা জায়গায় পার্ক করা আছে বেশকিছু গাড়ি। কিছু গাড়িতে স্টিকার লাগানো বিদেশি মেহমানদের আনা নেওয়ার কাজে নিয়োজিত। বাকিগুলো সাধারণ মুসল্লিদের। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের মারকাজ কাকরাইল মসজিদের এই ব্যতিক্রম চিত্র। যা অন্য কোনো মসজিদের সঙ্গে মেলে না। কারণ, অন্য মসজিদগুলো এশার নামাজের পরই তালাবদ্ধ হয়ে যায়।
মসজিদের গেটে দায়িত্ব পালনকারীদের দু’জন পাবনার, একজন মৌলভীবাজার ও অন্যজন ময়মনসিংহ জেলার। তারা তিন চিল্লার জন্য বাড়ি থেকে এসেছেন। চিল্লার ফাঁকে পাহারার জামাতে আজ দায়িত্ব পড়েছে মসজিদের গেট পাহারা দেওয়ার।
গভীর রাতেও দেখা গেলো ছোট ছোট জটলা বেঁধে তাবলিগের সাথীরা আসছেন। বিশেষ করে এসএসসি সমমানের পরীক্ষা শেষ হওয়ায় এখন যুবকদের জামাত বেশি আসছে।
কাকরাইল মসজিদ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে বিভিন্ন কারণে অতি সুপরিচিত। মসজিদটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো সন, তারিখ পাওয়া না গেলেও এটা নির্মাণের ব্যাপারে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। কাকরাইল মসজিদের মুরুব্বিদের কাছে জানা যায়, বর্তমান মসজিদ নির্মাণের পূর্বে এখানে নবাব পরিবারের নির্মিত স্বল্প পরিসরে একটি মসজিদ ছিল। যার অস্তিত্ব এখন আর নেই।
দুই একর জমিতে তিনতলা মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদের নিচতলায় রয়েছে অজুখানার হাউজ। এ ছাড়া মসজিদের বাইরেও রয়েছে অজুখানা। মসজিদ থেকে একটু দূরে উত্তর পাশে মলমূত্র পরিত্যাগের জন্য রয়েছে দোতলা একটি ভবন।
কাকরাইল মসজিদের সবকিছুই হয় মুসল্লিদের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। মসজিদের সঙ্গে পাঁচতলা ভবনে একটি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। কায়দা থেকে মেশকাত শরিফ পর্যন্ত পড়ালেখার ব্যবস্থা রয়েছে। মাদ্রাসায় কিছু বিদেশি ছাত্রসহ মোট তিন শতাধিক ছাত্র রয়েছে এখানে।
মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববী, ফিলিস্তিনের বায়তুল মোকাদ্দাস- এই তিনটি বাদে আল্লাহর ঘর বিবেচনায়; ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে সব মসজিদের মর্যাদা সমান। তবে বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের মারকাজ- কাকরাইল মসজিদ একটু ব্যতিক্রম।
ঢাকার ঐতিহাসিক রমনা পার্কঘেঁষা এই মসজিদের ভেতরে-বাইরে উল্লেখ করার মতো কোনো জৌলুস নেই। বিশ্বজোড়া এই মসজিদের পরিচয় ও খ্যাতি থাকলেও মসজিদটি একেবারেই সাদামাটা। নেই সুউচ্চ মিনার। মিনারের চূড়ায় আর সব মসজিদের মতো চারমুখী মাইক নেই। সারি সারি ফ্যান নেই। নরম গালিচা, ঝাড়বাতি, অজুখানা কোনো কিছুতেই বিলাসিতা নেই।
ঢাকার অগণিত মসজিদের উচ্চ মিনার থেকে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত আজান হয় মাইকে। তাবলিগ জামাতের প্রাণকেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে কখনো মাইকে আজান দেওয়া হয় না। এমনকি নামাজের সময়ও ইমাম মাইকে সূরা-কিরাত পড়েন না। শুধু মসজিদে নামাজ পড়ার সময় কেবল মুয়াজ্জিনের জন্য মাইক ব্যবহার করা হয়। তবে তাবলিগের আম বয়ানের সময় মাইক ব্যবহার করা হয়।
কাকরাইল মসজিদে বেতনধারী সার্বক্ষণিক কোনো ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেম নেই। তাবলিগের দায়িত্বশীলরাই পালাক্রমে এসব দায়িত্ব পালন করেন। এখানে সবকিছু চলে পরামর্শের ভিত্তিতে। এমনকি তাবলিগে অংশগ্রহণকারীদের জন্য মসজিদ আঙিনায় প্রতিদিন যিনি খাবার রান্না করেন তারও কোনো বেতন নেই। যিনি মসজিদের সামনে পাহারা দিচ্ছেন তিনিও কোনো বেতনধারী লোক নন। তাবলিগে এসে পালাক্রমে এই খেদমত করছেন।
কাকরাইল মসজিদের আদি নাম ছিল মালওয়ালি মসজিদ। পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার উত্তর-পশ্চিম কোণের খান মুহাম্মদ মসজিদ থেকে ১৯৫২ সালে কাকরাইল (মালওয়ালি) মসজিদে তাবলিগ জামাতের মারকাজ স্থানান্তর হয়। এর আগে দু’বার খুলনায় ও তিনবার ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় তাবলিগের মারকাজ স্থানান্তর হয়।
কাকরাইল মসজিদে মূলত ফজরের নামাজের পর রাত পর্যন্ত চলে তাবলিগ জামাতের নানা কার্যক্রম। ফজরের নামাজের পর এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিশেষ বয়ান হয়। এরপরই মুসল্লিদের নিয়ে চলে হেদায়েতের বয়ান। তাবলিগ জামাতের কাজ কীভাবে করতে হবে এই বয়ানে তার দিক-নির্দেশনা থাকে। দোয়া, তালিমে বসা, জিকির করা, নামাজ পড়া, খেদমত করা এবং মহল্লার লোকজনকে মসজিদে আনার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
জোহরের নামাজের পর চলে তালিম। এতে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ক. কিতাব থেকে পড়া (ফাজায়েলে আমল ও মুন্তাখাবে হাদিস) খ. সূরা-কেরাতের অনুশীলন করা গ. তাবলিগের ছয় উসূল তথা ছয় নম্বরের ছয়টি গুণের ওপর আলোচনা করা।
তাবলিগের আলোচিত ছয়টি গুণ হলো- কালেমা (ঈমান), নামাজ, ইলম (জ্ঞানচর্চা) ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমীন (মুসলমানদের পারস্পরিক সৌহার্দ), ইখলাসে নিয়ত (সংকল্পের একনিষ্ঠতা) এবং তাবলিগ। তাবলিগি সাথীরা এই ছয়টি গুণ নিজের মধ্যে আনার চেষ্টা থাকে।
আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দ্বীনের কাজের জন্য নানা উৎহব্যঞ্জক বয়ান চলে। বাদ মাগরিব সূরা ইয়াসিন পড়ে বিশ্ববাসীর জন্য সম্মিলিত দোয়া হয়, যারা জামাত থেকে ফিরেছেন তাদের থেকে কারগুজারি (দিনলিপি) শোনা এবং তাদের কাজের ধরণ জানার ব্যবস্থা করা হয়।
মাগরিবের পরে কাকরাইলে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ভাষায় বয়ান বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশি লোকদের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া এবং যেসব মাসতুরাত জামাত রয়েছে সেসব জামাতের মহিলা সদস্যদের আগত মেহমানদের ভাষায় পর্দার আড়ালে রেখে মাইকের মাধ্যমে বয়ান শোনানো হয়। এশার নামাজের পর হায়াতুস সাহাবা গ্রন্থ থেকে পড়ে শোনানো হয়। দোয়া শেষে সবাই বিশ্রামে চলে যান।
কাকরাইল মসজিদের বিদেশি মেহমানদের জন্য থাকা-খাওয়ার আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও সেটা খুব আহামরি কিছু নয়। সবসময়ই এখানে বিদেশি মেহমান থাকেন। কাকরাইল মসজিদে তাবলিগের কাজ পরিচালনার জন্য রয়েছে ১৫ জন শুরা সদস্যের এক কমিটি।
কাকরাইল মসজিদকে বলা হয় বাংলাদেশের জিন্দা মসজিদ। কারণ এই মসজিদে সবসময়ই মুসল্লি থাকে। জিন্দা মসজিদের অস্থায়ী বাসিন্দারা সমাজ জিন্দা করার বাসনায় এখানে আসেন। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি, থাকার কষ্ট, ঝড়-বৃষ্টি ও তীব্র শীতের কষ্টকে জয় করে জিন্দা মসজিদে আগতরা একদিন সমাজকে আলোকিত করবে এই আশা রইল।
বাংলাদেশ সময়: ০৪১৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৬
এমএ/