ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

হোশি কুনিও হত্যার নেতৃত্বে থাকার স্বীকারোক্তি জাহাঙ্গীরের

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৯
হোশি কুনিও হত্যার নেতৃত্বে থাকার স্বীকারোক্তি জাহাঙ্গীরের

ঢাকা: রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেন জঙ্গি জাহাঙ্গীর আলম। এ ঘটনা ছাড়াও উত্তরবঙ্গে বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা হয়েছে তার নেতৃত্বে। 

বুধবার (৩০ অক্টোবর) হলি আর্টিজানে নৃশংস জঙ্গি হামলা মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে দেওয়া বক্তব্যে এ দাবি করেছেন জাহাঙ্গীর নিজেই।  

অবশ্য জাপানি নাগরিক হত্যায় যে পাঁচজনকে আড়াই বছর আগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে জাহাঙ্গীরের নাম নেই।

বুধবার দুপুরে সন্ত্রাসীবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় তিনি এ জবানবন্দি দেন।  

এ মামলায় মোট ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শেষ হয়। বুধবার মামলার শুনানির শুরুতেই আদালতের অনুমতিতে আগে সাক্ষ্য দেওয়া এক অপ্রাপ্ত বয়স্ক সাক্ষীকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।

এরপর দুপুর দুইটার দিকে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন আসামি জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে আবু ওমর। এ সময় কাঠগড়া থেকে তাকে ডায়াসের কাছে নিয়ে জবানবন্দি রেকর্ড করেন বিচারক। প্রায় পৌনে একঘণ্টা ধরে জাহাঙ্গীর আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেয়।  

এরপর আধঘণ্টার বিরতিতে যান আদালত। পরে আরেক আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান তার বক্তব্য আদালতে তুলে ধরে। আদালতে লিখিতভাবে বক্তব্য দেয় বাকি ছয় আসামিও।  

আদালতে জাহাঙ্গীর বলেন, আমি ২০০২ সালে জেএমবি (নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন) তে যোগ দিই। ২০০২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমি জেএমবির উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালন করি। ২০১৪ সালে ইরাক ও সিরিয়ায় খেলাফত ঘোষণা হলে তামিম চৌধুরী ও সারোয়ার জাহানের মাধ্যমে খেলাফতের বাইয়াত (আনুগত্য) গ্রহণ করি ও আইএসে যোগদান করি।  

‘তামিম ও সারোয়ার জাহান মানিক আমাকে আইএস এর উত্তরবঙ্গ শাখার সামরিক প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন। তারপর থেকে আমি উত্তরবঙ্গে বেশকিছু অভিযান পরিচালনা করি। আমার মাধ্যমেই জাপানি নাগরিক হোশিও-কে হত্যা করা হয়। এছাড়া কুড়িগ্রামে মুসলিম থেকে খ্রিস্টান হওয়ার কারণে হোসেন আলীকেও হত্যা করি। এরকম বেশকিছু অভিযান আমি সেখানে পরিচালনা করি। ’

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমি উত্তরবঙ্গে আইএস-এর সামরিক শাখার দায়িত্ব পালন করি।

‘২০১৬ সালের ১ মার্চ মারজান থ্রিমা অ্যাপের মাধ্যমে আমাকে সিরাজগঞ্জ ফুড ভিলেজ হোটেলে আসতে বলা হয়। আমি ওইদিন বিকেল ৪টায় সেখানে উপস্থিত হই। রোহান ইমতিয়াজ স্বপন ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বলকে নিয়ে আমি একটি অভিযান পরিচালনা করি। একই বছর ১৫ মে মেজর জাহিদ থ্রিমা অ্যাপের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জ হাইওয়ের হানিফ হোটেলে রোহান ইমতিয়াজ, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খাইরুল ইসলাম পায়েলকে নিয়ে আসতে বলেন। আমি তাদের নিয়ে গেলে মেজর জাহিদ তাদের নিয়ে চলে যান। আমার জানামতে, গুলশান হামলায় এই তিনজনকে জাহিদ ও সারোয়ার জাহান মানিক প্রশিক্ষণ দেন। হামলাকারীদের মধ্যে এই তিনজন ছিল। ’

‘২০১৬ সালের ২০ মে তামিম চৌধুরী থ্রিমা অ্যাপের মাধ্যমে ঢাকা চিড়িয়াখানায় আসতে বলে। ওইদিন দুপুর ১২টায় আমি চিড়িয়াখানায় ঢুকি। ওইখানে যাওয়ার পর মানিক, বাশারুজ্জামান চকলেট, মারজান, নাঈম, তাওসিফ তারেক এদের তামিম চৌধুরীর সঙ্গে আগে থেকে বৈঠক করতে দেখি। তখন তামিম চৌধুরী উত্তরবঙ্গের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। তামিম এদের তখন কিছু দিক-নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। সারোয়ার ও তাওসিফ দুজনকে তামিম কিছু গ্রেনেড তৈরি করতে বলেন এবং বাশারুজ্জামান চকলেট, নাঈম ও তারেককে বোমা সরবরাহ থেকে শুরু করে এ টু জেড দায়িত্ব প্রদান করেন। তারপর আমি উত্তরবঙ্গে চলে যাই। ’

তিনি বলেন, ‘উত্তরবঙ্গে বেশকিছু অভিযানের কারণে প্রশাসন আমাকে খুঁজছিল। তখন আমি তামিমকে বিষয়টি জানাই। তখন তিনি আমাকে আসতে বলেন। ২০১৬ সালের ২০ জুন কল্যাণপুরে হানিফ কাউন্টারে নামি। এ সময় চকলেট আমাকে রিসিভ করে তামিমের বাসায় নিয়ে যান। এখানে বাসায় ঢুকে সারোয়ার জাহান মানিক, তামিম চৌধুরী, তানভীর কাদরী ও তার দুই ছেলে বাশারুজ্জামান চকলেট এবং গুলশান হামলার পাঁচজন রোহান ইমতিয়াজ স্বপন, খাইরুল ইসলাম পায়েল ওরফে বাধন, শফিকুল ইসলাম উজ্জল, মোবাশ্বের ও নিবরাসকে দেখতে পাই। একদিন পর মারজানও এই বাসায় চলে আসেন। ’

‘যেহেতু গুলশান বিষয়ে আমাকে জানাতো না, কিন্তু এই হামলার তিনজন রোহান, পায়েল ও উজ্জ্বল আমার কাছে ছিলেন। ২০ মে তামিম চৌধুরী যাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারাই তা সংগ্রহ করে তামিমের বাসায় নিয়ে আসেন। বাশারুজ্জামান চকলেট অস্ত্র নিয়ে আসেন। তারেক ও নাঈম গ্রেনেড নিয়ে আসেন। আমি ২০১৬ সালের ২৫ জুন রোহানকে জিজ্ঞাসা করি ঢাকা শহরে কোথাও কি হামলা হবে? তারা তখন পর্যন্ত হামলার বিষয়ে কিছু জানতে পারেননি। ’

আসামি জাহাঙ্গীর বলেন, ‘তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন- আপনি কি জানেন? উত্তরে আমি বললাম, আমিও জানি না। ২৭ জুন তারিখে আমি তাদের আবারও এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি। তখন তারা বলেন- তামিম তাদের বেশ কয়েকটি স্থান দেখতে বলেছেন।

‘তখন তামিম আমাকে বলেন, ১ জুলাই আপনি এ বাসা থেকে চলে যাবেন। তখন পর্যন্ত তামিম, মারজান ও সারোয়ার জাহান মানিক ছাড়া কেউ জানতো না কোথায় হামলা হবে। তারপর ১ জুলাই ৮টায় পায়েল আমাকে বলে ঢাকায় হামলা হবে, তবে কই হবে সেটা আপনাকে বলতে নিষেধ করা হয়েছে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। তামিম ও মানিক সকাল ১০টায় বলে আপনি যেখানে বাসা নিয়েছেন সেখানে পুনরায় চলে যান। আমাকে বলেন, ভাইদের জন্য দোয়া করবেন। কোনো সময়ই যেন মোবাইল বন্ধ না হয়। তখন আমি বেলা ১১টায় তামিমের বাসা থেকে সিরাজগঞ্জ চলে যাই। তারপর তামিম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা ৮টার মধ্যে আমাকে আপডেট খবর নিতে বলেন এবং বলেন ভাইদের জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাদের শহীদ হিসেবে কবুল করেন। ’

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ৩ জুলাই তামিম ও মারজান আমাকে মিরপুর ১০-এ ডাকেন এবং ৫০ হাজার টাকা দেন। এরপর ১০ জুলাই উত্তরবঙ্গের দায়ী বিভাগের প্রধান রজবকে কল্যাণপুরে ডাকি। তাকে রিসিভ করতে এসে কাউন্টার টেরোরিজমের হাতে ধরা পড়ি।

‘২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আমাকে গুম করে রাখা হয়। এরপর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আমাকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে এবং বিভিন্ন ভাইদের ধরে এনে ক্রসফায়ারে দেন। আমাকেও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেন। যারা এই হামলায় জড়িত না তাদেরও আমার মাধ্যমে জড়িয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেন। এখানে যারা আছে তারা কেউ এই হামলায় জড়িত না। ’

জাহাঙ্গীরের বক্তব্য রেকর্ডের পর কিছুক্ষণ বিরতিতে যান আদালত। এরপর মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানও আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন। তিনি নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ বলে দাবি করেন।  

জবানবন্দিগ্রহণ শেষে আদালত আগামী ৬ নভেম্বর মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করেন। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে এই মামলার বিচারকাজ শেষ হবে। এরপর আদালত মামলার রায় ঘোষণা করবেন।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদের গুলিতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গুলশান থানায় একটি মামলা করেছে পুলিশ।

২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আটজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর। একই বছর ৮ আগস্ট চার্জশিট গ্রহণ করেন আদালত। পরে ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই হামলার বিচার শুরু হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ২১২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৯
কেআই/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।