ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আরও

কুমিল্লা উত্তর জেলা যুবলীগের পদ বাগাতে মরিয়া বিতর্কিতরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩
কুমিল্লা উত্তর জেলা যুবলীগের পদ বাগাতে মরিয়া বিতর্কিতরা

কুমিল্লা: আওয়ামী যুবলীগের কুমিল্লা উত্তর জেলা শাখার নতুন কমিটি শিগগিরই ঘোষিত হবে বলে আলোচনা তৈরি হয়েছে। এই ইউনিটের শীর্ষ পদ পেতে উত্তর জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সংশ্লিষ্ট মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।

 

কুমিল্লা উত্তর জেলা যুবলীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের ‘ক্লিন ইমেজ’ গড়ে উঠলেও এই ইউনিটের শীর্ষ পদ কুক্ষিগত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত, বিতর্কিত ও মামলার আসামিরা। জোর তদবির চালাচ্ছেন নানা মহলে। যুবলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বাসা ও অফিসে দৌড়ঝাঁপ করছেন তারা। এদের দৌড়ঝাঁপে উদ্বিগ্ন দুঃসময়ের ত্যাগী ও তৃণমূলের কর্মীরা। তাদের দাবি, মানবিক যুবলীগের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সংগঠনটির জেলা কমিটির নেতৃত্বে দুঃসময়ে রাজনীতি করা ত্যাগী নেতা-কর্মীদের প্রাধান্য দেওয়া হোক। যদি না দেওয়া হয় তাহলে তার প্রভাব পড়তে পারে আগামী নির্বাচনের মাঠেও।

২০১৯ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসে শেখ ফজলে শামস পরশকে চেয়ারম্যান ও মাইনুল হোসেন খান নিখিলকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি ঘোষিত হয়। চাঁদাবাজ, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ও বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে ঘোষিত ওই কমিটি কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রশংসা কুড়ায়। এর ধারাবাহিকতায় বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে তৃণমূলের ইউনিটেও কমিটি করার নির্দেশ দেয় যুবলীগের অভিভাবক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।  

২০০৩ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে স্বপন-বাহার কমিটি, তারপর সবশেষ ২০১৫ সালে বাহাউদ্দিন বাহারকে আহ্বায়ক ও সারোয়ার হোসেন বাবুকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। তবে সাংগঠনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা ও দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ২০২১ সালের ২ অক্টোবর এ কমিটি বিলুপ্ত করে পরশ-নিখিলের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় কমিটি।

সংগঠন সূত্রে জানা যায়, ওই কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পর নতুন কমিটির জন্য নেতা-কর্মীদের কাছে জীবনবৃত্তান্ত চাওয়া হয়। নতুন কমিটিতে স্থান পেতে শতাধিক নেতা-কর্মী কেন্দ্রে জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন।

 

জানা গেছে, কমিটিতে শীর্ষ পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিতর্কিত, অপকর্মে জড়িত ও মামলার আসামি রয়েছেন। এর মধ্যে সভাপতি পদপ্রত্যাশী বিল্লালুর রশীদ দোলন, সারোয়ার হোসেন বাবু এবং সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী সাইফুল ইসলাম শামীম, মামুনুর রশীদ ও জসিম উদ্দিন লিটন ওরফে ভিপি লিটন ও আবু কাউসার অনিকও রয়েছেন। তবে তাদের নামে রয়েছে অভিযোগের পাহাড়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ইউনিটের সভাপতি পদপ্রত্যাশী বিল্লালুর হোসেন দোলনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, তার বাবা আব্দুল করিম মাস্টার মুক্তিযুদ্ধের সময় দাউদকান্দি উপজেলার শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। দাউদকান্দি উপজেলা রাজাকারদের নামের তালিকায় তার বাবা আব্দুল করিমের নাম রয়েছে ১৫ নম্বরে। এছাড়া তিনি মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে এ সংক্রান্ত মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিল্লালুর হোসেন দোলন বলেন, এটা ভুল। মিথ্যা কথা। আমার বাবাকে পাক হানাদার বাহিনী মেরেছে। এলাকার কিছু মানুষ আছে ফেসবুকে অপপ্রচার করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এটা ভুয়া তালিকা। দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের নৌকা মনোনীত চেয়ারম্যান আমার ভাই।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দেশনেত্রী শেখ হাসিনার ছবি ও ছাত্রলীগ অফিস ভাঙচুরের মামলা চলমান থাকা সারোয়ার হোসেন বাবুর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদ সুবিদ আলী ভূইয়া সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলন করেন। মাদক ব্যবসায় জড়িত ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন বিজিবির হাতে। কমিটি বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে ক্ষান্ত হননি, বাধ্য করেছেন পদ দিতে। এই মর্মে মো. কাউসার ভূইয়া তিতাস থানায় ২০২০ সালে ২২ মে সাধারণ ডায়রি করেন। সবশেষ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে তার নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।

দেবিদ্বার উপজেলা যুবলীগের সদস্য সাইফুল ইসলাম শামীম উত্তর জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী। তার বিরুদ্ধে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। ২০২১ সালে দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে তিনি সরাসরি কাজ করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।

কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উপজেলা যুবলীগের সদস্য শামীম আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল হক খোকনের সমর্থনকারী এবং পরে প্রকাশ্যে বিএনপি প্রার্থীর ধানের শীষ মার্কার পক্ষে কাজ করেন। নৌকা মার্কার প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করেন এবং ইউনিয়ন আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করার কথা বলেন। এছাড়া অনেক প্রিজাইডিং অফিসারকে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে ফোন করে চাপ প্রয়োগ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ’  

‘জয় বাংলা ধানের শীষ’ ধারণার প্রবর্তক তিনি। মুখে জয় বাংলা বললেও তিনি সবসময় ধানের শীষের পক্ষে কাজ করেছেন বলে জানা যায়। বিদ্যুৎ নিয়ে দুর্নীতির কারণে মন্ত্রী না হয়েও পুরো দেবীদ্বার এলাকায় তাকে ‘বিদ্যুৎ মন্ত্রী’ হিসেবে ডাকা হয়।

ওই তদন্ত প্রতিবেদনের মন্তব্যে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ বলেছে, তার নেতিবাচক ভূমিকার কারণে ওই নির্বাচনের পাশাপাশি পুরো উপজেলায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মনে করেন।

এছাড়া ওই উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল হক খোকনের মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় ২৫০ জন ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত তালিকায় তার নাম ছিল। ২০০৮ সালের উপজেলা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন সাইফুল ইসলাম। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন না করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘বিএনপির পক্ষে কাজ করার প্রশ্নই আসে না। আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। জেলা আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। এটি একপেশে তদন্ত প্রতিবেদন। তারা আংশিকভাবে প্রতিবেদন করেছে। দেবিদ্বারের সর্বস্তরের জনগণ এই প্রতিবেদন মানে না। ’

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থনে স্বাক্ষরযুক্ত ভোটার তালিকায় তার নাম থাকার বিষয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আব্দুল হক খোকন আমার চাচা, আমারা আব্বার আপন ফুফাতো ভাই। উনি পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। শুধু তালিকায় আমার নামটা দিয়ে রেখেছেন, এটাই। ’

সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি দেবিদ্বারের বরকামতা ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক মো. হারুনুর রশিদের ওপর হামলা করে তার আঙ্গুল কেটে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধে। সেদিন হত্যার উদ্দেশ্যে মামুন ও তার সহযোগীরা হারুনুর রশিদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০ ছুরিকাঘাত করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনা নিয়ে দেবিদ্বার উপজেলা যুবলীগ মানববন্ধনও করেছে। এছাড়া চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল তিতাস উপজেলার যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেনের হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি মামুনুর রশীদের আপন ছোটো ভাই মাসুদ। তাকে আসামি করে মামলা হলে তিনি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখনই তিনি পুলিশের হাতে আটক হন। তবে তিনি এখন জামিনে রয়েছেন।

তবে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আমার জড়িত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করি দলের জন্য। যার ওপর হামলা হয়েছে উনি যুবলীগের কেউ নন। আগে বিএনপির সঙ্গে রাজনীতি করতেন। ব্যক্তিগত রেষারেষিতে এ ঘটনা হতে পারে। রাত ১২টার পরের ঘটনা, এটা হামলা না ডাকাতি উনি বলতে পারবেন। ’

উত্তর জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী জসিম উদ্দিন লিটন ওরফে ভিপি লিটন ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এলাকার ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার বিরুদ্ধে টেন্ডার শিডিউল বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়সহ অনেকের সম্পত্তি দখলের মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে লিটনের বিরুদ্ধে। জমি দখলের অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা চলমান। এ কারণে এলাকা ছাড়া ও স্থায়ীভাবে আবুধাবিতে বসবাস করছেন।

অবশ্য এখন খোলস বদলে লিটন হয়েছেন সাংবাদিক। এ পরিচয়ে মিডিয়া-চ্যানেল তৈরি করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে প্রতারণা করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এছাড়া আরেক সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী আবু কাউসার অনিক ইতিমধ্যে ধর্ষণ মামলায় আটক হয়ে জেল খেটেছেন। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা ও চাঁদাবাজির মামলা। এসব মামলায় তিনি এক নম্বর আসামি।

বিতর্কিতদের পদ বাগানোর এই দৌড়ঝাঁপে উদ্বিগ্ন কুমিল্লা উত্তর জেলা যুবলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী বলেছেন, এরা পদে এলে সংগঠনের পরিচয়ে ত্যাগী এবং রাজপথের লড়াকু কর্মীদের কোণঠাসা করে ফেলবে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দল যখন ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলছে, তখন বিতর্কিত ও মামলার আসামিদের বাদ দিয়ে ক্লিন ইমেজের নেতাদেরই প্রাধান্য দিতে হবে। আর এটা তৃণমূলসহ গোটা দলের জন্যই কল্যাণকর হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০. ২০২৩ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।