ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

অবৈধ থ্রি-হুইলার নিয়ে হাইওয়ে পুলিশের উৎকোচ কারবার!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩
অবৈধ থ্রি-হুইলার নিয়ে হাইওয়ে পুলিশের উৎকোচ কারবার! এ অবৈধ বাহন ধরা ছাড়া নিয়ে সাভার হাইওয়ে থানায় চলে তুঘলুকি কারবার

সাভার (ঢাকা): উচ্চ আদলতের নির্দেশ ও সড়ক পরিবহন আইন-২০০৮ অনুযায়ী মহাসড়কে থ্রি-হুইলারের মতো যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবুও সাভারের মহাসড়কগুলোতে যত্রতত্র চলাচল করছে অবৈধ এসব বাহন।

এ অবৈধ বাহন ধরা ছাড়া নিয়ে সাভার হাইওয়ে থানায় চলে তুঘলুকি কারবার।

অভিযোগ আছে, প্রাথমিক জরিমানার কম টাকা নিয়েই অনেক সময় থানা কম্পাউন্ড থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় থ্রি-হুইলার (ব্যাটারি চালিত রিকশা)। আবার কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট মাসোহারা দিয়েই এ অঞ্চলের মহাসড়কে ঝুঁকি নিয়ে অবাধে চলছে এসব যানবাহন।

এতে করে আইনের দোহাই দিয়ে থ্রি-হুইলার ধরা ছাড়া এ লুকোচুরির খেলায় কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা লাভবান হলেও সরকার হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব। অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জেনেও একই ভুল করে বারবার জরিমানা কিংবা উৎকোচ দিয়ে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চালাচ্ছেন চালকরা। এতে করে যেমন মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

থ্রি-হুইলার চালকদের অভিযোগ, সাভার হাইওয়ে থানার কিছু পুলিশ কর্মকর্তা অভিযানের সময় তাদের উপর নির্যাতন চালায়। ধাওয়া দিয়ে তাদের থ্রি-হুইলার ধরতে গেলে অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে। থ্রি-হুইলার ধরে থানায় আনার পর ২ হাজার ৬০০ টাকা জরিমানার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। আবার অনেক সময় জরিমানার কম অর্থ দিলেই মামলা ছাড়াই থ্রি-হুইলার চলার অনুমতি মেলে। দালাল চক্রের কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা আতাত করে মাসোহারার মাধ্যমেও মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচলের অনুমতি দেয়।

থ্রি-হুইলার নিয়ে এসব অভিযোগের অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাংলানিউজের প্রতিবেদকের কাছে সাভার হাইওয়ে পুলিশ ও দালাল চক্রের হাতে অসহায় চালকদের হয়রানির নানা প্রমাণ মেলে। গত ২৯ জানুয়ারি দিনভর সাভার হাইওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুর রহিমের থ্রি-হুইলার আটকের অভিযান পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে মেলে আরও তথ্য। যেখানে অবৈধ থ্রি-হুইলার আটক করতে গিয়ে পুলিশের ওই কর্মকর্তা ব্যবহার করছেন আরেক অবৈধ বাহন লেগুনা। এমনকি থ্রি-হুইলার আটক অভিযানে পুলিশের সঙ্গে অংশ নিচ্ছে নামধারী কিছু দালাল চক্রের সদস্যরাও। এছাড়া সার্ভিস লেনে থ্রি-হুইলার আটকের আইন না থাকলেও পুলিশ কর্মকর্তারা সেসব তোয়াক্কা করছেন না।

আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় মিজানুর রহমান নামে হাইওয়ে পুলিশের এক কনস্টেবলকে দেখা যায় সার্ভিস লেনে একটি থ্রি-হুইলার আটক করতে। এ সময় চালককেও আঘাত করেছেন তিনি। অভিযানের নামে পুলিশের এ দলটির এমন অনিয়মের চিত্র দেখা যায় পল্লিবিদ্যুৎ বাস স্ট্যান্ড, পলাশবাড়ি স্ট্যান্ড, বাইপাইল স্ট্যান্ড, ইপিজেড এলাকা, চক্রবর্তী এলাকাগুলোতে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সাভার হাইওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক আব্দুর রহিম বলিয়াপুর থেকে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলার অনুমতির বিনিময়ে মাসিক ৩০ হাজার টাকা উৎকোচ নেন জনৈক দালাল কাশেমের মাধ্যমে। এছাড়া আশুলিয়ার শ্রীপুর এলাকার ল্যাংরা আলম, সুমন, পিচ্চি মামুন ও বাদশার মাধ্যমে প্রায় ২০০ ইজিবাইক থেকে মাসোহারা নেন ওই কর্মকর্তা। প্রতিটি ইজিবাইক থেকে মাসিক ২ থেকে ৩ হাজার টাকা হারে প্রায় ৬ লাখ টাকা মাসোহারা নেন তিনি।

সম্প্রতি মাসোহারা দেওয়ার পরও থ্রি-হুইলার আটক করতে গেলে ক্ষুব্ধ জনতার হাতে গণধোলাইয়ের শিকার হন এক ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা। এসময় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেন থ্রি-হুইলার চালকরা। পরবর্তীতে এ ঘটনায় ট্রাফিক পুলিশের এসআই হেলাল উদ্দিন ও রেকার ড্রাইভার কনস্টেবল আশরাফকে ক্লোজড করা হয়।

বাইপাইল এলাকার থ্রি-হুইলার চালক খাইরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমার গাড়ি দু’বার ধরেছে হাইওয়ে থানা। পুলিশতো মূলত গাড়ি ধরে না। গাড়ি তো ধরে তাদের সঙ্গে থাকা দালালরা। একবার এক অসুস্থ যাত্রীকে টেনে নামিয়ে দিয়ে আমাকে দুইটা ঘুষি মেরে রিকশাটা নিয়ে যায় দালালরা। পরে সন্ধ্যায় ২৬০০ টাকা দিয়ে গাড়ি ছাড়ায়া ছিলিপ আনি। এর ১৫ দিন পর আবার আমার গাড়ি ধরে। আমি অনেক বলছি, কান্নাকাটি করে হাতে পায়ে ধরছি কিন্তু ছাড়েনি। পরে থানায় নিয়ে ২৬০০ টাকা নিয়ে সিলিপ না দিয়েই পাঠিয়ে দিছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রিকশা চালক বাংলানিউজকে বলেন, মহাসড়কে রিকশার অভিযানের নামে পুলিশ অনেক অনিয়ম অত্যাচার করে আমাদের উপরে। যেগুলো কারো চোখে পড়ে না। বেশিরভাগ সময় জরিমানার কম ১ হাজার থেকে ১৫শ’ টাকা নিয়ে মামলা ছাড়াই থ্রি-হুইলার ছাড়িয়ে দেয় দালালরা। পুলিশের সঙ্গে এ দালালদের যোগসাজস আছে। এ দালালরাই পুলিশের সঙ্গে আবার অভিযানে থ্রি-হুইলার ধরতে যায়। মহাসড়কে যাতে পুলিশ গাড়ি না ধরে সেজন্য দালালদের মাসিক ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দিলে সমস্যা থাকে না। মাসিক এ টাকাগুলো দালালদের মাধ্যমে পুলিশের কাছে যায়।

শ্রীপুর এলাকার ল্যাংড়া আলম হাইওয়ে পুলিশের হয়ে কাজ করে। সে মাসোহারার এ টাকা আদায় করে। তার সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশ রহিমের সখ্যতা আছে।

অভিযোগের বিষয়ে সাভার হাইওয়ে থানার উপ-পরির্দশক (এসআই) আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, আমি কোথাও থেকে মাসোহারা নেই না। আমি জানিও না। আর আদালতের নির্দেশনা মেনেই আমি ওইদিন অভিযান পরিচালনা করেছি।

সাভার হাইওয়ে থানার পরিদর্শক (ওসি) আজিজুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা আদালতের নির্দেশনা মেনে মহাসড়কে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। প্রতিনিয়ত থ্রি-হুইলারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।

এসআই রহিম মাসোহারা নিয়ে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচলের অনুমতি দেন, বিষয়টি জানতে চাইলে ওসি বলেন, এ ঘটনা আমার জানা নেই। তবে এরকম কিছু হলে আমি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো।

তবে আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে অভিযান পরিচালনা, সার্ভিস লেন থেকে থ্রি-হুইলার আটক ও চালকদের নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেন হাইওয়ে ওসি।

এ বিষয়ে গাজীপুর হাইওয়ে রিজয়নের পুলিশ সুপার (এসপি) মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে কথা বলতে রাজি হলেও সাভার হাইওয়ে থানার কথা শুনতেই ব্যস্ততার কথা বলে ফোন কেটে দেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২৩
জেডএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।