ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

যেখানে খেতে টাকা লাগে না, ভালো কাজ করলেই মেলে খাবার

ইফফাত শরীফ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০২৩
যেখানে খেতে টাকা লাগে না, ভালো কাজ করলেই মেলে খাবার ভালো কাজের হোটেলে মিলছে বিনামূল্যে ইফতার

ঢাকা: সারাদিন রিকশা চালিয়ে ঠিক ইফতারের আগ মুহূর্তে বাসাবো বৌদ্ধমন্দিরের সামনের রাস্তায় হাজির মো. জাহাঙ্গীর আলম। সেখানে দেয়ালে বড় বড় করে লেখা ‘ভালো কাজের হোটেল’।

এর আগে আরেক রিকশাচালক মো. মফিজ মিয়া থেকে তিনি জানলেন, এখানে বিনামূল্যে ইফতার বিতরণ করা হয়। তবে সেই ইফতার পেতে হলে তাকে একটা ভালো কাজের কথা শোনাতে হবে। তবেই মিলবে ইফতার।

এ কথা শুনে অন্তত একটি ভালো কাজ করার প্রত্যয়ে রিকশা চালাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর। সে সুযোগও মিলল তার। একজন অন্ধ লোককে হাইকোর্টের সামনে থেকে সদরঘাটে পৌঁছে দিয়ে আসলেন তিনি।  

আর এই জ্যামের শহরে এমন ভালো কাজ করতে গিয়ে আজ তার ইনকামও বেশি হয়নি। তাই ইফতারি কেনার সামর্থ্য তার ছিল না।  

তবে রিকশাচালক জাহাঙ্গীরকে আশাহত করেনি ‘ভালো কাজের হোটেল’-এর আয়োজকরা। মাগরিবের আজান দেওয়া আগেই তার হাতে ফ্রি ইফতার বক্স উপহার দিয়েছেন তারা।  

ভালো কাজ করে শুধু যে জাহাঙ্গীর আলম এবং মফিজ মিয়াই এখান থেকে ইফতার পেয়েছেন বিষয়টি এমন নয়। তাদের মতো আরও অনেকেই ভালো কাজের বিনিময়ে পেয়েছেন ইফতার। আর এই কর্মসূচির নাম-ই ‘ভালো কাজের হোটেল’।  

শুক্রবার (২৪ মার্চ) রাজধানীর বাসাবো বৌদ্ধমন্দিরের থেকে কয়েকশত গজ সামনে ঠিক খিলগাঁও ফ্লাইওভারে ওঠার আগে রাস্তার পাশের ফুটপাতে এই ভালো কাজের হোটেলের দেখা মেলে।  

রাস্তার ফুটপাতের পাশে খোলা আকাশের নীচে এই হোটেলটি চেনার উপায় হচ্ছে দেয়ালে বড় করে লেখা আছে ‘ভালো কাজের হোটেল এবং এখানে খেতে টাকা লাগবে না, যে কোন একটি ভালো কাজ কারলেই হবে’।

‘ভালো কাজের হোটেলে’যে কোনো অসহায় এবং ছিন্নমূল মানুষ এসে খাবার খায়। এখানে সবাই বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন। কেউ কাউকে চেনেন না। কেউ কারো আত্মীয় নন। তারপরও অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি হলেও নেই কোনো কোলাহল, হুড়োহুড়ি।  

আজ দেখা গেল, ঘণ্টাখানেক আগেও তারা কেউ কাউকে চিনতেন না। অথচ সুশৃঙ্খলভাবে বসে তারা ইফতার করছেন। হয়তো আর কখনো দেখাও হবে না। তবু পরস্পরের মধ্যে অভূতপূর্ব দরদ লক্ষ্য করা গেল। এ যেন সংযমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের এক অপার দৃশ্য। পবিত্র মাহে রমজানে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের এ যেন এক পরম নিদর্শন।

ছিন্নমূল শিশু সোহান দীর্ঘ চার বছর যাবত এই ভালো কাজের হোটেলে খাবার খান। অনেক সময় ভালো কাজ না করলেও যখন হাতে কোনো টাকা পয়সা থাকে না, এখানে এসে খাবার খান। আজকেও ইফতারি করতে এসেছেন ভালো কাজের হোটেলে।  

শিশু সোহানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, তার বাড়ি সিলেটের সুনামগঞ্জে। আগে পরিবারের মা বাবা, বোন সবাই ছিল। কিন্তু তার মা মারা গেলে বাবা একমাত্র বোনকে অন্যের কাছে পালক দিয়ে দেন। তারপর থেকেই পরিবারের প্রতি অভিমান করে ঢাকায় চলে আসেন শিশু সোহান। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন কমলাপুরের স্টেশনে অন্য ছিন্নমূল শিশুদের সঙ্গে।  

প্রথম রমজান তাই শিশু সোহান ইফতার করতে চলে এসেছেন ‘ভালো কাজের হোটেলে’। সঙ্গে আরও চার বন্ধু ও এক বড় ভাই আছেন। যারা প্রত্যেকেই ছিন্নমূল। এরা সবাই পারিবারিক শিষ্টাচার শিখতে পারেনি। তবুও সিরিয়াল ধরে বসেছেন খাবার খাচ্ছেন। কারণ, তারা এখানের খাবারের নিয়ম জানেন। ইফতার শেষে শিশু সোহান এবং তার চার বন্ধু ও এক বড় ভাই খাবারের অবশিষ্ট ময়লাগুলো সুন্দর করে ডাস্টবিনে ফেলেন।  

এমন শিষ্ঠাচার কোথা থেকে শিখলেন তাদের কাছ থেকে জানতে চাইলে জবাবে বাংলানিউজকে তারা বলেন, আমরা অনেক দিন ধরে এখানে খাবার খাই। আমরা জানি এখানে ভালো কাজের বিনিময়ে খাবার খেতে হয়। আগে ভালো কাজ না করেই মিথ্যা বলে খাবার খেতাম। তবে এখন আর মিথ্যা বলে খেতে ভালো লাগে না। তাই কোনো ভালো কাজ যদি নাও করি তারপরও খাবার শেষে ময়লাগুলো গুছিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলি। আমাদের কাছে এটাও একটা ভালো কাজ।  

ভালো কাজের হোটেলের সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক মাহমুদুল হাসান অনিক বাংলানিউজকে বলেন, এবারের রোজা আমাদের বেশ কিছু খাবারের মেনু আছে। আজকে আমরা মুরগির তেহারি পরিবেশন করছি সঙ্গে এক গ্লাস পানি, শরবতও আছে। আমাদের ভ্রাম্যমাণ ছয়টা শাখা আছে। যার মধ্যে ঢাকায় পাঁচটি এবং চট্টগ্রাম একটি। সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ জনের ইফতার আয়োজন করে থাকি আমরা।  

তিনি বলেন, যাদের কিনে খাওয়ার সামর্থ্য আছে, তবে বাসে যাতায়াত করার কারণে খাবার কেনার অবস্থাটা তাদের নেই। তাদেরকেও আমরা বিনামূল্যে বাসে বাসে গিয়ে ইফতার বিতরণ করে থাকি। আমাদের এখানে ছিন্নমূল থেকে শুরু করে রিকশাচালকরা পর্যন্ত ইফতার পেয়ে থাকে। প্রথমে লাইন ধরে খাবারগুলোকে রাখা হয়। তারপরে আজানের আগ মুহূর্তে তারা এসে খাবারের সামনে বসে পড়ে। এবং খাবার শেষ হলে যার যার ময়লাগুলো নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে তারপর তারা এখান থেকে যায়। লাইন ধরে ফুটপাতে বসিয়ে খাবার খাওয়ানোর কারণ হচ্ছে যেহেতু আমাদের কোনো স্থান নেই। আমরা ফুটপাতে খাবার খাওয়াই। রাস্তায় যেন জ্যাম না লেগে যায় তাই তাদেরকে সিরিয়াল ধরে বসে খাবার খাওয়াই।  

বিনামূল্যে যে খাবার খাওয়াচ্ছে এর অর্থায়ন কোথা থেকে এসেছে জানতে চাইলে সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক মাহমুদুল হাসান অনিক বাংলানিউজকে বলেন, পুরো দেশে আমাদের প্রায় দুই হাজার ডেইলি টেন মেম্বার আছেন। এই ডেইলি টেন মেম্বাররা প্রতিদিন দশ টাকা হারে মাসে ৩০০ টাকা ডোনেট করেন। এছাড়াও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন যারা এককালীন বেশ ভালো পরিমাণ টাকা ডোনেট করে থাকেন। পাশাপাশি বেশকিছু কোম্পানিও আমাদের ডোনেট করে। তাদের এই চাঁদার কন্ট্রিবিউটের মাধ্যমেই আমাদের এই ভালো কাজের হোটেলের কার্যক্রম চলে।  

তিনি বলেন, এই ভালো কাজের হোটেলে যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। তখন উৎসবগুলোতে অসহায় মানুষদেরকে খাওয়ানো হতো। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে প্রতি সপ্তাহে একদিন করে আমরা কমলাপুর অসহায় লোকদের খাওয়াতাম। তবে করোনার সময় লকডাউন যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেদিন থেকে আমরা এখন পর্যন্ত নিয়মিত খাবার খাওয়াচ্ছি অসহায় এবং ছিন্নমূলদের।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০২৩
ইএসএস/এসএএইচ
   


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।