ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কিশোরীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করাতেন আরাভ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫২ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০২৩
ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কিশোরীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করাতেন আরাভ

ঢাকা: পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম ঢাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কিশোরী ও নারীদের দিয়ে দেহব্যবসা করাতেন।  

সেই কাজে সহায়তা করতে নিজের তৎকালীন স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়াকেও বাধ্য করেছিলেন আরাভ।

আদালতে দেওয়া দুই কিশোরী ও কেয়াসহ অন্য আসামিদের জবানবন্দিতে আরাভের এই দেহ ব্যবসা করানোর কথা উঠে এসেছে।

বন্ধু রহমত উল্লাহ ও পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খানকে ফাঁসাতে যেসব নারী ব্যবহার করেন আরাভ, তাদের মধ্যে ছিল এই দুই কিশোরী।  

মামুন এমরান হত্যা মামলার আসামি তারা (ঘটনার সময় অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তাদের নাম প্রকাশ করা হলো না)। সম্পর্কে তারা ছিলেন দুই বোন।  

আদালতে এ দুই বোনসহ সুরাইয়া আক্তার কেয়া জবানবন্দি দেয়, অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করতেন রবিউল তথা আরাভ খান।

২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সত্যব্রত শিকদার ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় কেয়ার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।  

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, পাঁচ বছর আগে ফেসবুকে সম্পর্ক করে রবিউল ইসলামের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই জানতে পারি, রবিউল আলাদা বাসা নিয়ে মেয়েদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করায়। মাঝেমধ্যে রবিউল মেয়েদের সঙ্গে খরিদ্দারদের আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করে। এক সময় আমিও তার সঙ্গে এই কাজে জড়িয়ে পড়ি। গত জুন মাস হতে (২০১৮ সাল) রবিউলের পূর্ব পরিচিত দুই বোন আফতাব নগরে আমাদের বাসায় থাকতো। যার মধ্যে বড় বোন আমার স্বামীর দেহব্যবসার কাজে নিয়োজিত ছিল।

এরপর মামুন এমরান খান হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন সুরাইয়া আক্তার কেয়া। আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্র ও আসামিদের করা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে জানা যায়, মূলত, আসামি রহমত উল্লাহর সঙ্গে বনানীর ওই বাড়িতে এসেছিলেন পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খাঁন। রহমত উল্লাহকে ফাঁসানোর ইচ্ছা থাকলেও তার সঙ্গী মামুন একপর্যায়ে হয়ে যান ঘটনার শিকার। তর্কবিতর্কের জেরে আসামি স্বপন সরকার, মিজান শেখ, আতিক হাসান ও দিদারসহ অন্য আসামিদের মারধরে নিহত হন মামুন। পরে রবিউলের দেওয়া বস্তায় রহমতউল্লাহর গাড়িতে করে গাজীপুরে নিয়ে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় তার মরদেহ।

পুরো ঘটনায় ১০ জন আসামির সম্পৃক্ততা থাকলেও রবিউল তথা আরাভই ছিল এসবের মূল পরিকল্পনাকারী। দুই বোনকে আশ্রয় দিয়ে তিনি তার কুকর্মে কাজে লাগান।  

২০১৮ সালের ১৯ জুলাই দুই বোন ঘটনার বিষয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন। ছোট বোনের জবানবন্দি রেকর্ড করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদা আক্তার।  

জবানববন্দিতে তিনি বলেন, আমরা দুই বোন খুব ছোট তখন আমার মা মারা যায়। আমার বাবা অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। আমরা মামার কাছে বড় হতে লাগলাম। মামি আমাদের খুব ভালোভাবে নিতো না। পরে আমরা দুই বোন আলাদা হয়ে যাই। আমার বোনের সঙ্গে রবিউল ভাইয়ের পরিচিত হয়। রবিউল তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া ও আমরা দুই বোন আফতাব নগরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকি। আমার বোন ইন্ট্রা কোম্পানিতে চাকুরি নেয়। সেখানে ঠিকমতো বেতন না দেওয়ায় সে ওই চাকুরি ছেড়ে দেয়। সে ললিতকলা একাডেমিতে নাচ করতো। এছাড়াও সে নাটক ক্রাইম ফিকশন সিরিজ ইত্যাদিও করতো। এভাবে সংসার চালানোর জন্য সে মিডিয়াতে কাজ শুরু করে।

বড় বোন যে রবিউলের আশ্রয়েই জড়িয়ে পড়েন দেহ ব্যবসায় তা নিজের দেওয়া জবানবন্দিতেই স্বীকার করেছেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই একই দিনে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নুরুন্নাহার ইয়াসমিন মেহেরুন্নেছার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।  

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, আমি তেজগাঁও কলজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। রবিউল ভাই আমার পূর্ব পরিচিত। আমি আর আমার বোন দুজনে হোটেলে থাকতাম। রবিউল ভাইয়ের সঙ্গে একদিন দেখা হয়। এরপর একদিন হাতিরঝিল রবিউল ভাই আর তার বউয়ের সঙ্গে দেখা হয়। রবিউল ভাইয়ের প্রস্তাবে আমরা দুই বোন ওনার আফতাবনগরের বাসায় শিফট হই। বাসায় উঠার কয়েকদিন পর জানতে পারি ভাই-ভাবি আলাদা বাসায় মেয়েদের দিয়ে দেহব্যবসা করান। আমিও ২/৩ বার দেহব্যবসার কাজে বনানীর বাসায় যাই। আমি ইউটিউব চ্যানেলে এ্যাক্ট করতাম। জিটিভিতে ক্রাইম ফিকশেনে কাজ করার সুবাদে ইঞ্জিনিয়ার রহমত উল্লাহর সঙ্গে পরিচয় হয়। তার সাথে কথা হতো, তার সাথে একবার শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে আমার। রবিউল ভাই আর ভাবি রহমত উল্লাহর কথা শুনে বলে যে, বনানীর বাসায় নিয়ে এসে তার সঙ্গে আমার আপত্তিকর ছবি তুলে তাকে ব্লাকমেইল করে টাকা আদায় করবে।

সেই পরিকল্পনা মাফিকই রহমত উল্লাহকে আনা হয় ওই বাসায়। তার ধারাবাহিকতায় রহমত উল্লাহর সঙ্গী মামুন এমরান খাঁন সেখানে এসে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

এই দুই বোন ঘটনার সময় অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তাদের আলাদা বিচার হচ্ছে শিশু আদালতে। অপরদিকে চার্জশিটভূক্ত অপর ৮ আসামির বিচার হচ্ছে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফয়সল আতিক বিন কাদেরের আদালতে।  

এই ৮ আসামির মধ্যে রবিউল ও তার স্ত্রী কেয়া পলাতক। বাকি ৬ জন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। তারা হলেন- রহমত উল্লাহ, স্বপ্ন সরকার, মিজান শেখ, আতিক হাছান, দিদার পাঠান ও সারোয়ার হোসেন।

রবিউল পলাতক থেকে আবু ইউসুফ নামে অন্য একজনকে নিজ নামে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে পাঠান। ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর আবু ইউসুফ আসামি রবিউলের পরিচয়ে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান।  

পরের বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি নিজের পরিচয় প্রকাশ করে জামিন আবেদন করেন তিনি। আদালত সেই আবেদনের বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশকে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন।  

২০২১ সালের ৩১ মে ডিবির খিলগাঁও জোনাল টিমের উপপরিদর্শক মনিরুজ্জামান প্রতিবেদন দাখিল করে বলেন, প্রকৃত আসামি রবিউল ও আবু ইউসুফ এক ব্যক্তি নন। এরপর ওই বছর ৩ জুন কোতয়ালি থানায় অন্যের রূপ ধারণ করে প্রতারণার অভিযোগে আবু ইউসুফের নামে একটি মামলা হয়। একইসঙ্গে তাকে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যা মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।  

এই আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ সিএমএম আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করেন। এরপর মামলাটি বদলি হয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতে আসে। ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

২০২২ সালের ২৮ জুলাই মামলার বাদী ও নিহতের বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। এরপর গত ২১ জুন আসামিদের জেরার মধ্য দিয়ে তার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ৪ জুন দিন ধার্য রয়েছে।

মামলাটির বিচারকাজ ৬ মাসের মধ্যে শেষ করতে ইতোমধ্যে উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছে। তবে নির্দিষ্টি সময়ের মধ্যে বিচারকাজ শেষ হওয়া নিয়ে সন্দিহান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আব্দুস সাত্তার দুলাল।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মামলায় ৩৮ জন সাক্ষী। সবার জবানবন্দি শেষ করে ৬ মাসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করা অসম্ভব। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে আমরা সচেষ্ট আছি। নিয়মিত সাক্ষী হাজির করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই মামলাটি শেষ করার চেষ্টা থাকবে আমাদের।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৯ জুলাই গাজীপুরের জঙ্গল থেকে মামুন ইমরান খানের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় মামুনের ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদী হয়ে বনানী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০২৩
কেআই/এসএএইচ


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।