নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র ও তাদের স্থানীয় এজেন্টরা।
মানবপাচারকারী চক্রের ভয়ংকর ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে গ্রামের তরুণ ও যুবসমাজ।
মেঘনা তীরের বিশনন্দি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ঘরে ঘরে চলছে মাতম। দালালচক্রের ভয়ে পাচার হয়ে যাওয়া তরুণ ও যুবকদের ব্যাপারে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন তাদের অভিভাবকরা।
জনপ্রতি ১ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দিয়ে গত বৃহস্পতিবার দালালচক্রের জিম্মিদশা থেকে বাড়িতে ফিরে এসেছে তিন যুবক। তারা হলেন বাদশা মিয়া, সুমন মিয়া ও নাজমুল। গত ১৭ থেকে ২০ মার্চের মধ্যে আড়াইহাজারের কড়ইতলা, রামচন্দ্রী, মানিকপুর, চৈতনকান্দা, দয়াকান্দা, টেটিয়া ও শম্ভুপুরা থেকে অন্তত ৩০ জন যুবক পাচার হয়েছে। সাতটি গ্রামজুড়ে চলছে শোকের মাতম। সন্তানকে ফেরত পেতে অভিভাবকরা হয়ে পড়েছেন দিশেহারা।
জানা গেছে, প্রথমে টাকা লাগবে না বলে দালালচক্র যুবকদের মায়ানমার, উখিয়া বা কক্সবাজারের কোনো গোপন আস্তানায় নিয়ে আটকে রাখে। এরপর তাদের জিম্মি করে জনপ্রতি ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
জানা গেছে, দালালচক্রের কাছে আটক ৩০ জনের মধ্যে ৬ জনের নাম মিলেছে। তারা আপাতত আটক আছে টেকনাফ এলাকায়।
তারা হলো-আড়াইহাজারের কড়ইতলার বিল্লাল, জুয়েল, আব্দুল্লাহ হাসান, আমির হোসেন, ইয়াসিন ও শাহপরান। তারা টেকনাফে কালু দালালের কাছে জিম্মি আছে। ত্রিশ জনের মধ্যে ছয়জনের নাম প্রকাশ পেলেও বাকিদের নাম প্রকাশে ভয় পাচ্ছেন বাবা-মা ও অভিভাবকরা। ভয়ের কারণ নাম ঠিকানা প্রকাশ করলে দালালচক্র আটক যুবকদের নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে।
আড়াইহাজার সদরের বড় দালাল হচ্ছে আবু সাঈদ। তার বাড়ি নরসিংদী জেলার ফজলুরকান্দি গ্রামে। এ এলাকাটি পড়েছে আড়াইহাজার ও নরসিংদী জেলার সীমানার মধ্যবর্তী স্থানে। তাই মানবপাচার চক্রের বড় দালাল আবু সাঈদকে কেউ সহজে খুঁজে পায় না।
টেকনাফের ভয়ংকর কালু দালালের আস্তানায় আটকে থাকা আব্দুল্লাহ হাসানের মা ও আমির হোসেনের ভাই আলী হোসেন জানান, দালালরা প্রতিনিয়ত আমাদের ফোন করে সাড়ে ৪ লাখ করে টাকা চাইছে। এ টাকা না পাঠালে আটক যুবকদের হত্যা করা হবে। হতদরিদ্র মানুষগুলো দিন আনে দিন খায়। তারা সাড়ে ৪ লাখ টাকা চোখেও দেখেনি। তারা এত টাকা পাবে কোথায়? তাই ঘরে ঘরে মাতম চলছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একজন যুবক পাচার করতে পারলে ক্ষুদে দালাল কমিশন পায় ৫ হাজার টাকা। মানিকপুর, রামচন্দ্রী, চৈতনকান্দা ও দয়াকান্দা গ্রামে ক্ষুদে দালালদের আনাগোনা বেশি। তারাই গ্রামের সহজ সরল কিশোর যুবকদের টোপ দেয়। দালালচক্র যেনতেন টোপ দেয় না। আবার ক্ষুদে দালালরাও বড় দালালদের ফাঁদে পড়ে। বড় দালালের নির্দেশ ঠিকমত পালন না করলে ক্ষুদে দালালদেরও তারা ছাড়ে না।
রামচন্দ্রীর চিহ্নিত ক্ষুদে দালাল শরীফ,পারভেজ ও সফর আলী এবার মানবপাচার করতে গিয়ে নিজেরাই ফাঁদে পড়ে যায়। বড় দালালরা তিন ক্ষুদে দালালকে মিয়ানমার পাঠিয়ে আটক করেছে। ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ক্ষুদে দালাল শরীফ ফিরে এসেছে।
ক্ষুদে দালালরা খুবই আকর্ষণীয় টোপ দেয়। মুক্তি পাওয়াদের ভাষ্যমতে তাদের কথার ধরন অনেকটা এমন, ‘আরে মিয়া এক টাকাও লাগবে না। তুমি খালি কয়টা জামাকাপড় লইবা। ব্যস বাদবাকি দায়িত্ব আমাগো। গাড়িতে চইড়া কক্সবাজার যাইবা। দুই দিন কক্সবাজার সমুদ্র দেখবা। হোটেলে থাকবা। একটু মউজ ফুর্তি করবা। এরপর প্রথমে বড় ট্রলারে কইরা নাফ নদী পাড়ি দিয়া সমুদ্রের ছোট জাহাজে উঠতে হবে। ছোট জাহাজ থেকে বড় জাহাজে উঠলেই সব চিন্তা শেষ। তুমি মালয়েশিয়া পৌছাইয়া যাইবা। ’
তাদের আরও বলা হয়, ‘সেখানে আমাগো কোম্পানির লোক আছে। ভালো চাকরিতে লাগাইতে একমাস সময় লাগে। কোনো সমস্যা নাই থাকা খাওয়া ফ্রি। তবে শর্ত অইলো কাজে লাগলে মাসে মাসে আমাগো টাকা শোধ কইরা দিবা। আর বাড়িতে টাকা পাঠাইবা। তোমার আব্বায় কত কষ্ট কইরা তোমারে বড় করছে। তোমার কি পরিবারের লইগা কোনো দায়িত্ব নেই। দায়িত্ব থাকলে চুপি চুপি চলো আমাগো লগে। কাউরে কিছু কইবা না। মালয়েশিয়া গিয়া খালি টাকা পাঠাইবা। দেখবা তোমার বাপ-মা কত খুশি হবে। আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখবো। ’
দালালদের এমন মিষ্টি কথায় পড়ে কিশোর তরুণরা পটে যায় জানিয়ে অভিভাবকরা বলেন, কারণ বেকার ছেলেগুলো সত্যিই বাবা মার কষ্ট সহ্য করতে পারে না। জোয়ান পোলা পরিবারের জন্য কিছু করতে চায়। কিন্তু পরিবারের মঙ্গলের কথা ভেবে তারা যে দালালচক্রের চোরাবালির ফাঁদে পা বাড়াচ্ছে- সে কথা সহজে বুঝতে পারে না। কারণ দু একজন ছেলে এভাবেই মালয়েশিয়া গিয়ে ভালো কাজ করছে। ওই ছেলে যে দালালচক্রের নিজস্ব লোক, সে কথা গ্রামের সহজ সরল একজন কিশোর বুঝবে কিভাবে?
দালালদের ইমোশনাল কথাবার্তায় বেকার ছেলেরা একটা রিস্ক নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে রাতের আঁধারে বাবা-মাকে কিছু না বলে কিছু জামা-কাপড় সম্বল করে দালালচক্রের পেছনে পেছনে ছোটে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে। দালালচক্র যে তাদের জিম্মি করে টাকা দাবি করবে- সে কথা কিছুতেই টের পায় না কিশোর-তরুণরা।
মালয়েশিয়ার জঙ্গলে নিয়ে বা জাহাজে থাকতেই দালালচক্র তাদের মারধর করে হাত-পা বেঁধে রাখে। এরপর দেশে ফোন করে বাবা-মার কাছে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে ওই কিশোরকে হয় জাহাজ থেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। না হয় মালয়েশিয়ার জঙ্গলে পেট কেটে মেরে ফেলে। বা গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। সাপের কামড় বা বিচ্ছুর কামড়ে ওই হতভাগ্য তরুণের মৃত্যু ঘটে।
মানবপাচার সমন্ধে অভিবাসী ফোরাম বিশনন্দির মজিবুর রহমান সরকার ও ডা. শেখ নেয়ামতউল্লাহ সুমন জানান, এ ইউনিয়নের মানিকপুর ও চৈতনকান্দা গ্রাম থেকে দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে ৩০ জন যুবক জিম্মিদশায় আছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন ফিরে এসেছে। কেউ কেউ আটকা পড়ে আছে। আমরা গ্রামে গ্রামে হেঁটে হেঁটে জনগণকে মানবপাচারকারী দালালচক্র সম্পর্কে সতর্ক করছি। তাদের বোঝাচ্ছি।
বিশনন্দি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, আমরা প্রশাসনকে অনুরোধ করবো তারা যেন মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দালালচক্র নিরীহ যুবকদের নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
ওকাপ এর আড়াইহাজার উপজেলার ফিল্ড অফিসার আমিনুল হক বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে আড়াইহাজারে মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে কাজ করে আসছি। সম্প্রতি হঠাৎ করেই যুবক শ্রেণি দালালচক্রের ফাঁদে পা বাড়াচ্ছে। আমরা যুবসমাজকে বুঝিয়ে ওই চক্রের ফাঁদ থেকে ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছি।
আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ এমদাদুল হক তৈয়ব বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমি অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেব। তাছাড়া আমি গ্রামবাসীদের বলবো আপনারা সতর্ক থাকুন। আপনাদের সন্তানদের এভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন না।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০২৩
এমআরপি/জেএইচ