বরিশাল: চৈত্রের মাঝারী থেকে ভারি বর্ষণে বিপাকে পড়েছেন বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক তরমুজ চাষি। বৃষ্টি ও অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষেতের তরমুজ নিয়ে এখন বিপদে এলাকার চাষিরা।
অগণিত তরমুজ যে শুধু ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে, এমনটা নয়- পানিতে তলিয়ে যাওয়া ক্ষেতের তরমুজ পাইকার মোকামে আনা হলেও পচন ধরছে এবং নষ্ট হচ্ছে ফলগুলো। ফলে বরিশালের মোকাম সংলগ্ন জেলখালসহ কীর্তনখোলা নদী তীরে মৌসুমের রসালো ফল তরমুজ ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় পাঁচ মাস পর মার্চের মধ্যভাগ থেকে কয়েক দফা হালকা বৃষ্টিপাত এবং মাসের শেষভাগে মাঝারী ও ভারি বর্ষণের সঙ্গে ফুসে ওঠা সাগরের জোয়ারের পানিতে বরিশাল, ভোলা সদর, চরফ্যাশন, পটুয়াখালীর খেপুপাড়া, বরগুনার বামনা, পাথরঘাটা ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়াসহ উপকূলীয় এলাকার তরমুজ ক্ষেতগুলোতে পানি জমে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছেন চাষিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, এবারো দেশে আবাদ ও উৎপাদনের ৭০ ভাগেরও বেশি তরমুজের যোগান দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল। দর ভালো পাওয়ায় দিন দিন তরমুজ চাষে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের। তবে এবার চৈত্রের বর্ষণে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল স্বপ্নের তরমুজে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটছে কৃষকের।
বরিশালের সবচেয়ে বড় পাইকারী ফলের মোকাম পোর্ট রোড ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ট্রলার আড়তের খালে নোঙর করে আছে। কোনোটির পণ্য নামানো হচ্ছে। কোনোটিতে চাষি আর আড়তদারের মধ্যে দর কষাকষি চলছে। আর এরমাঝেই ফেলে দেওয়া হচ্ছে পঁচে যাওয়া তরমুজ। আর সেই তরমুজ সংগ্রহ করছে ছিন্নমূল আর নিম্ন আয়ের মানুষ! আবার এগুলোর মাঝেই বিচরণ করতে দেখা গেছে গরু-ছাগলকে। যারা ফেলে দেওয়া ওই তরমুজ খেয়ে দেখছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার বাড়ি বরিশাল থেকে জানানো হয়েছে, পটুয়াখালীতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ না হলেও আবাদ হয়েছে বিভাগের সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ৭৪৫ হেক্টর জমিতে। এছাড়া বরগুনায় ১১ হাজার ৫১২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে ১৫ হাজার ৮৩৮ হেক্টর জমিতে এবং ভোলায় ১১ হাজার ২৪৯ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে ১৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমিতে।
এছাড়া বরিশাল জেলায় তরমুজ চাষে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭০০ হেক্টর জমি, তবে আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৪৬ হেক্টর জমিতে। পিরোজপুরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৬ হেক্টর জমি, আবাদ হয়েছে ১১৬ হেক্টর জমিতে। আর পটুয়াখালীর মতো ঝালকাঠিতেও লক্ষ্যমাত্রা না থাকলেও ৫৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে।
ভোলার তরমুজ চাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, ফলন ভালো হলেও অসময়ে বৃষ্টি হওয়ায় পুরো ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। এখন পাইকারও পাচ্ছি না। এজন্য ট্রলারে করে বরিশালে নিয়ে আসছি, কিন্তু এখানেও তরমুজের দর উঠছে না। খুচরা বাজারে যে তরমুজটি বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে দুইশ টাকায়, আমরা সেটির দাম ৫০-৬০ টাকাও পাচ্ছি না।
আর ভালো দামের আশায় বরিশালে ট্রলারভর্তি তরমুজ নিয়ে আসতে আসতে অনেক তরমুজ ট্রলারে পঁচে গেছে বলে জানিয়েছেন পিরোজপুরের তরমুজ চাষি আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, পচে যাওয়া তরমুজ ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, ফেলে দেওয়া এসব তরমুজ পঁচে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন রসুলপুর কলোনির বাসিন্দা রাসেল। তিনি বলেন, জোয়ার ভাটার কারণে পচা তরমুজ ভেসে যতদূর যাচ্ছে ততদূরেই গন্ধ ছড়াচ্ছে। যদিও কিছু পঁচা তরমুজ গরুতে খেয়ে সাবাড় করছে, তবে তার থেকেও বেশি পড়ে আছে খাল ও নদী তীরে।
বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়েদুল আলম বলেন, তরমুজ আহরণের ভরা মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ায় এবার কৃষক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর এই বৃষ্টি হয়েছিল আহরণের পরে। যে কারণে ওই বছর ভালো দাম পেয়েছিলেন চাষিরা।
যদি বৃষ্টি আরও কিছু দিন পরে হতো, তবে বিগত যে কোনো বছরের তুলনায় চাষিরা এবার বেশি লাভবান হতে পারতো- এমনটাই জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি পটুয়াখালীর অতিরিক্ত পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের উদ্যান বিশেষজ্ঞ জিএমএম কবীর খান বলেন, এবার বরিশাল অঞ্চলে তরমুজের ভালো ফলন হয়েছে। সারাদেশে যে পরিমাণ তরমুজের ফলন হয়েছে, তার প্রায় ৭০ শতাংশই এই অঞ্চলের। ফলন ভালো হলেও বৃষ্টির কারণে চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়েছে। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে তরমুজ ক্ষেতে পানি জমে গেছে।
তিনি বলেন, শিলার আঘাতে তরমুজে পচন ধরে, আবার তরমুজ কয়েকদিন পানিতে ডুবে থাকলে ভেতরে পচন ধরতে পারে।
তবে চাষিরা বলছেন, ক্ষেত থেকে আহরণের পর বিক্রি পর্যন্ত বেশি সময় অতবাহিত হলেই তরমুজ পচে যাচ্ছে। তাই তারা আহরণের পর সল্প সময়ে ভোক্তা পর্যায়ে তরমুজ পৌঁছানোর প্রতি জোর দেওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৪, ২০২৩
এমএস/এনএস