ঢাকা, রবিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

পাহাড়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ, তারা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন চায়: বিচারপতি নাসিম

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০২৩
পাহাড়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ, তারা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন চায়: বিচারপতি নাসিম

ঢাকা: পার্বত্য চুক্তি নিয়ে পাহাড়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম।  

তিনি বলেন, পার্বত্য চুক্তি নিয়ে পাহাড়ের মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি এখনও তাই।

এই চুক্তি নিয়ে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মৌলিক কোনো বিভেদ নাই। পাহাড়ের সকল মানুষ চুক্তি বাস্তবায়ন চায়।

শনিবার (৮ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে দেশবাসীর দায় ও করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।  

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এই মতবিনিময় সভাটির আয়োজন করে।

১৯৭৯ সাল থেকে পাহাড়ে যে বাঙালি সেটলারকে নেওয়া হয়েছিল তার পেছনে খারাপ উদ্দেশ্য ছিল মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বলেন, তাদের কার জায়গায় বসানো হয়েছিল। পাহাড়িদের জায়গা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাদের নেওয়া হয়েছে, তার পেছনে উদ্দেশ্যই ছিল খারাপ। উদ্দেশ্য ছিল, পাহাড়িদের নাম্বার কমিয়ে দিয়ে বাঙালিদের নাম্বার বাড়িয়ে দেওয়া।

তিনি বলেন, তারপরেও আমি মনে করি, পার্বত্য চুক্তি নিয়ে পাহাড়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। পার্বত্য চুক্তি নিয়ে পাহাড়ের মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি এখনও তাই। এই চুক্তি নিয়ে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মৌলিক কোনো বিভেদ নাই। পাহাড়ের সকল মানুষ চুক্তি বাস্তবায়ন চায়।  

বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম বলেন, আমি আমার বন্ধু আনোয়ারুল হককে (পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান) জিজ্ঞেস করেছিলাম কমিশনের খবর কী। তিনি বলেছিলেন, পাহাড়ে তো যেতেই পারি না। গেলেই হরতাল ডাকে, অবরোধ দেয়। আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, অন্তত মিটিংগুলো যেন ঢাকায় করে। আমি জানিনা, তারা করতে পারবে কিনা।

এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, আমরা যে এটাকে শান্তি চুক্তি বলেছি, তার মানে এর আগে একটা অশান্তি ছিল। কেন অশান্তি ছিল, কারণ তৎকালীন সরকার পাহাড়ে বাঙালিদের মেজোরিটি বানিয়ে সেখানে পাহাড়িদের প্রান্তিক করে দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা সংঘাত বাধিয়ে দেওয়া। এই সংঘাত থেকে মুক্তির জন্য যে চুক্তি হয়েছিল, তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

তিনি আরও বলেন, চুক্তির ২৫ বছর পর এখন আমরা দেখছি, পাহাড়ে সংঘাত আরও বেড়েছে। পাহাড়ি-পাহাড়ির মধ্যে সংঘাত বেড়েছে, পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে বিরোধ বেড়েছে। এখন আবার দ্বন্দ্ব বেড়েছে।  

এই দ্বন্দ্ব নিরসনে ৫টি সুপারিশ করেন অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ। সেগুলো হলো-
প্রথমত- গণতান্ত্রিক সুষ্ঠু নির্বাচন করে প্রকৃত যারা প্রতিনিধি আছে, তাদের বের করে নিয়ে আসা।  
দ্বিতীয়ত- পাহাড়ি এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিল্পের সুষম বিকাশ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।  
তৃতীয়ত- ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ সাধন।
চতুর্থত- ভূমি মালিকানা ও ব্যবহারে নীতিমালা প্রণয়ণ করতে হবে।
পঞ্চমত- ভারত প্রত্যাগত শারণার্থী ও শান্তিবাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসনে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটা শুধু পাহাড়ের সমস্যা না, এটা একটা জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যার নিষ্পত্তি রাজনৈতিকভাবে করতে হবে। তার জন্য স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। এর জন্য যদি নাগরিকদের মধ্যে তাড়না তৈরী করা না যায়, তাহলে এই চুক্তির বাস্তবায়নে চাপ তৈরী হবে না।

তিনি বলেন, চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে নেগোসিয়েশন প্রসেসে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মত বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো ছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারই এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু যারা নেগোসিয়েশন প্রসেসে ছিল, তারাই আজকে সরকার গঠন করছে কিংবা প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় আছে। এই চুক্তি যদি বাস্তবায়ন করতে আরও দেরি করি, তবে দেশের জন্য একটা ভয়াবহতা তৈরী হবে। পাহাড় এখন ক্রমাগত ৯৭ পূর্ববর্তী ধারায় ফিরে যাচ্ছে। তার জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী এবং তার জন্য দেশবাসীকে সংগঠিত করতে হবে।

ড. মেসবাহ কামাল আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে একটি হলো- ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক সীমাবদ্ধতা। এই দেশটা যে বহু সংস্কৃতির দেশ, দেশের যে বহুত্ববাচকতা আছে, এই ‘ডাইভার্সিটি’র স্বীকৃতি মেলেনি সংবিধানে। ২০১৯ সালে বাঙালি ছাড়াও ৫০টি জাতিস্বত্বাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। এটা কেন ১৯৭২ সালে হয়নি? ১৯৭২ সালের সংবিধানের অন্যতম সীমাবদ্ধতা হলো- এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাঠামো। প্রশাসনিক কাঠামো যদি বিকেন্দ্রীকরণ না হয়, তাহলে সেটা গণতন্ত্রায়ণের জন্যও সমস্যা। পার্বত্য চুক্তিতে যে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের কথা বলা হয়েছে, সেটা বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে পুরো দেশের জন্য একটা পথিকৃৎ হতে পারে। আজকে ২৫ বছর হয়েছে গেছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদকে ক্ষমতায়ন করার জন্য এখনো কোনো বিধিমালা তৈরী করা হয়নি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার চেয়ে আমলাতান্ত্রিক অসদিচ্ছাই বেশি প্রবল বলে মনে করেন এই আদিবাসী গবেষক।

এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, জাতিসংঘের একটি পরিসংখ্যানে আছে যে, পুরো পৃথিবীতে ৫ ভাগ আদিবাসী। এই ৫ ভাগ আদিবাসীই পুরো পৃথিবীর ৮০ ভাগ জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। কাজেই পুরো পৃথিবী রক্ষার জন্য এই আদিবাসীদের রক্ষা করতে হবে। উন্নয়নের জন্য যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তার হটস্পট হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই পাহাড়, বন না থাকলে আদিবাসীরা তো থাকবেই না, আমাদেরও যাওয়ার জায়গা থাকবে না।

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ হয়েছে। এই পরিষদের বিধিমালা প্রণয়নের কথা মন্ত্রণালয়ের। আমার জনা মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ নিজ উদ্যোগে বিনা পয়সায় এই বিধিমালা তৈরী করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই বিধিমালা পাস হচ্ছে না। তাছাড়া চুক্তিতে বলা হয়েছে পাহাড় সম্পর্কিত যেকোনো আইন প্রণয়নে আঞ্চলিক পরিষদের পরামর্শ নেওয়া হবে। কিন্তু অনেকগুলো আইন আছে, যেগুলো আঞ্চলিক পরিষদ জানেই না।

পাহাড়ে যত আর্মি ক্যাম্প ও ক্যান্টনমেন্ট কমবে, তত বেশি শান্তি ফিরবে দাবি করে শামসুল হুদা বলেন, পাহাড়ে সিভিল প্রশাসন কাজ করতে পারে না। পাহাড়ে কাজ করে সামরিক প্রশাসন। এটা শুধু অন্যায় না। এটা অসাংবিধানিক এবং অঘোষিত। যদি কোনো জরুরী অবস্থা তৈরী হয়, তখন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকার সামরিক আইন ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু পাহাড়ে তো অঘোষিতভাবেই এটা চলছে। এটা আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি। কাজেই চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থেকে যতই আমরা দূরে থাকব, এসব ঘটনা অবাধে ঘটতেই থাকবে।

কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক শর্তগুলোই বাস্তবায়ন হয়নি। বলা হয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ‘উপজাতি’ অধ্যুষিত অঞ্চল হবে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হয়ে গেছে। কাজেই চুক্তি করে যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এই ধরণের মত বিনিময় সভা করে খুব একটা লাভ হবে না। আজকেও পত্রিকায় এসেছে, পাহাড়ে সাতজন মানুষ খুন হয়েছে। বলা হচ্ছে, কুকি-চীন নামের একটি ‘জঙ্গি গোষ্ঠী’র সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু এই সংঘাতের পেছনে যে সরকারের কোনো গোষ্ঠী জড়িত, তা যদি আমরা বুঝতে না পারি, তাহলে চুক্তি বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত হবে না।

পাহাড়ের প্রধান সমস্যা ভূমি- উল্লেখ করে সোহরাব হাসান আরও বলেন, এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটি ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু এই কমিশন একটি সভা করতে পারে না। সভা ডাকলে হরতাল, অবরোধ ডাকা হয়। কাজেই বুঝতে হবে, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে গেছে। কেন শুধু আমলাদের দায়ী করবো। পাহাড়ে কত বুদ্ধিজীবি, পেশাজীবি, রাজনৈতিক নেতা জমি কিনে ভূমি দখল করছে, তারও তালিকা করা জরুরী।  

অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলেও মনে করেন তিনি।  

ডাকসু’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, পাহাড়ে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ে ভূমি হারানো আদিবাসীরা কেন তাদের জমি ফেরত পাবে না। সেখানে কেন পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে বাঙালিদের প্রতিস্থাপন করা হবে। আমার টাকা থাকলেই কী আমি ইচ্ছামত জমি কিনতে পারবো? সেটা কীভাবে! কুমিল্লার মানুষ যদি বরিশালের সমস্ত জায়গা কিনে নেয়, তখন কী বরিশালের মানুষ মেনে নেবে? পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করে যদি আরও বিভেদ তৈরী করা হয়, তবে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।  

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের জনমতকে যদি চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে না পারি, তাহলে চুক্তি বাস্তবায়ন করাটা কঠিন বলেও মনে করেন ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

ডা. দিবালোক সিংহ বলেন, আদিবাসী সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্র ও মেহনতি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই মেহনতি ও দারিদ্র। অন্যদিকে পাহাড়ে যেমন নিপীড়িত আদিবাসী আছে, তেমনি সমতলেও নানাভাবে বঞ্চিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ আছে। এই সমস্ত মেহনতি ও দারিদ্র মানুষের লড়াইয়ের মধ্যে একটা সংযোগ তৈরী করতে হবে। তার জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আরও গণতান্ত্রিক করার জন্য দেশে যে স্বৈরচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের মেহনতি মানুষের আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে।  

পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও মানবাধিকার কর্মী জাকির হোসেনের সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মতবিনিময় সভার সমাপ্তি হয়।  

নির্ধারিত আলোচনার পূর্বে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০২৩
ইএসএস/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।