সিলেট: মোবাইল মার্কেট হিসেবে খ্যাত সিলেটের করিমউল্লাহ মার্কেট। নামে ঐতিহ্যের ছাপ থাকলেও কিছু ব্যবসায়ীর প্রতারণার কারণে মার্কেটের দুর্নাম ছড়াচ্ছে।
বিভিন্ন ব্রান্ডের কোম্পানিকে হুবহু কপি করে নকল তৈরি মোবাইল ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে প্রতারণা করা হচ্ছে। ফলে বদনামের প্রলেপ লাগছে করিম উল্লাহ মার্কেটের নামে।
সম্প্রতি এই ভয়ঙ্কর প্রতারণা ধরা পড়েছে মার্কেটটিতে। মোবাইল কিনতে যাওয়া ক্রেতার কাছে ‘কোম্পানির তৈরি রিফারবিশ সেট’ বলে ঠকানো হয়। পুরোনো মোবাইল মেরামত করে প্যাকেটজাত করে তা গ্রাহকের কাছে ‘কোম্পানি রিফারবিশ’ বলে বিক্রি করছেন কিছু দোকানি। আর এসব নকল মোবাইল নিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। তারা অভিযোগ করলেও উল্টে ব্যবসায়ী কর্তৃক হেনস্তার শিকার হতে হয়।
সম্প্রতি করিমউল্লাহ মার্কেটে নকল মোবাইল কিনে প্রতারণার শিকার হন নগরের পাঠানটুলার বাসিন্দা সুমন আহমদ।
তিনি বলেন, গত ৫ এপ্রিল করিম উল্লাহ মার্কেটের দ্বিতীয় তলার ১৭ নং দোকান ‘হেভেন টাচ’ থেকে একটি মোবাইল কিনেন। তিনি নতুন মোবাইল কিনতে গেলে দোকানি মোজাহিদ ইসলাম নতুন মোবাইল দেখালেও সেগুলোর গ্যারান্টি, ওয়ারেন্টি থাকলেও টেকসই হবে না জানিয়ে ‘কোম্পানি রিফারবিশ মোবাইল সেট’ ধরিয়ে দেন। সেটি অধিকতর টেকসই বলে গ্রাহককে প্রতারিত করেন। এভাবে শুধু সুমন আহমদ-ই নয়, প্রতিনিয়ত শত শত গ্রাহক প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন মোবাইল সেট বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা নামমাত্র কমিশন পায়। পক্ষান্তরে একটি নকল সেট বিক্রি করলে কমপক্ষে ২/৩ হাজার টাকা লাভ হয়। এই লালসায় তারা নকল সেট বিক্রিতে আগ্রহি বেশি।
রিফারবিশ সেট কি: মূলত; কোম্পানিগুলো থেকে তৈরি ওয়ারেন্টি ফেরত সেটগুলোকে পূণরায় নতুন রূপে স্বল্পদামে বাজারজাত করলে সেটিকে রিফারবিশ সেট বলা যায়। কিন্তু নামিদামি মোবাইল কোম্পানিগুলো সুনাম ধরে রাখতে কোনো রিভারবিশ সেট বাজারজাত করে না। যদিও অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের ক্ষেত্রে রিফারবিশ পণ্য বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু করিমউল্লাহ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা অসাধু পন্থা অবলম্বন করে প্রিন্টিং মুদ্রণের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হুবহু ব্রান্ডের মোবাইল বক্স তৈরি করে নেন। সেগুলোতে পুরোনো সেট মেরামত করে নতুন কেচিং লাগিয়ে নিম্নমানের চার্জার, ক্যাবল যুক্ত করে নতুন মোড়কে বাজারজাত করেন। এসব মোবাইল হাতে নিলে বা দেখে বুঝার সুযোগ নেই সেটি নকল।
সূত্র জানায়, এসব সেটকে কোম্পানির তৈরি রিফারবিশ সেট বলে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন। ভোক্তভোগীদের বেশিরভাগ গ্রাম থেকে আসা লোকজন হওয়ায় পরবর্তীতে এসে অভিযোগ করেও বিচার পান না। কিংবা লাঞ্ছিত হয়ে যেতে হয়। ইদানিং নগরের বেশ কয়েকজন ক্রেতা প্রতারণার শিকার হওয়াতে রিফারবিশ সেটের নামে নকল মোবাইলের বিষয়টি সামনে আসে।
ভূক্তভোগী সুমন আহমদ জানান, গত ৫ এপ্রিল অপ্পো মোবাইল কিনতে করিম উল্লাহ মার্কেটের ‘হেভেন টাচ’ দোকানে যাই। তখন দোকানি অপ্পো কোম্পানি রিফারবিশ টেকসই বলে সেটটি ধরিয়ে দেন। পরবর্তীতে দুই দিনের মধ্যেই সেটে নানা সমস্যা দেখা দিলে তিনি নকটস্থ অপ্পোর সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে যান। তখন বেরিয়ে আসে এটি তাদের কোম্পানির তৈরি সেট নয়। পরে ওই নকল মোবাইল নিয়ে ব্যবসায়ীর কাছে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি ক্ষেপে যান। তখন তাকে হেনস্তার চেষ্টা করলে মার্কেট মালিকের দ্বারস্থ হন। এরপর তারা বিষয়টি দেখে দিতে উদ্যোগী হন। তখন ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি জাকারিয়াকে বিষয়টি দেখে দিতে মার্কেট কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব দেন। এসময় মার্কেটসহ সভাপতিও স্বীকার করেন এসব মোবাইল কোম্পানির রিফারবিশ (নকল) এবং পুরো মার্কেটে হাজার হাজার পিস রয়েছে। প্রতিটি দোকানে এসব মোবাইল বিক্রি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অপ্পো মোবাইল কোম্পানির এরিয়া সেলস ম্যানেজার সুলতান আহমদ রাসেদ বাংলানিউজকে বলেন, রিফারবিশ কোনো মোবাইল আমাদের কোম্পানি তৈরি করে না। খোলা বাজারে যারা বড় বড় কোম্পানির নাম ও লোগো ব্যবহার করে মোবাইল তৈরি করে বিক্রয় করছেন এইটা নিঃসন্দেহে প্রতারণা। অপ্পো কখনোই নির্দিষ্ট ডিলার ছাড়া মোবাইল বিক্রি করে না।
তিনি বলেন, কোম্পানির নাম ব্যবহার করে নকল মোবাইল বিক্রির প্রতারণার তথ্য আমাদের কাছেও রয়েছে। ওইসব মোবাইলের আইএমই নাম্বার নাই। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে কোম্পানি ও ডিলারকে ব্যবস্থা নিতে বলেনি।
এ বিষয়ে করিমউল্লাহ মার্কেটের স্বত্বাধিকারী আতাউল্লাহ সাকেরের মোবাইলফোনে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি। মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদকে ফোন দিলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। তবে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন চৌধুরী মিশু বলেন, আমাদের মার্কেটে কোনো নকল মোবাইল বিক্রি হয় না। কেউ প্রমাণ করে দিতে পারেন, তবে ওই দোকানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, যে গ্রাহক প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। অভিযুক্ত দোকানির বিরুদ্ধে আমরা অ্যাকশনে যেতে চাচ্ছি। ওই গ্রাহক মোবাইল নকল বলে প্রমাণ করতে পারেননি।
এ বিষয়ে মোবাইল শপ হেভেন টাচের স্বত্বাধিকারী মুজাহিদ ইসলাম রিফারবিশ মোবাইল বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, মোবাইল অপ্পো কোম্পানির হলেও এগুলো ঢাকার কিছু পার্টি (লোক) সরবরাহ করে থাকে। এটি তারা নিজেরা তৈরি করেন না। তবে ভোক্তভোগী গ্রাহকের কাছে রিফারবিশ বলেই বিক্রি করেছি। কিন্তু আইএমই নম্বর উল্লেখ করলেও সঠিকতা যাচাইয়ে না আসার বিষয়ে তিনি কোনো সদোত্তর দেননি।
এদিকে, এক ভোক্তভোগীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার নড়েচড়ে বসে করিমউল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি। তারা সতর্কীকরণ নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দেন মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করে মাস্টার কপি ত্রুটিপূর্ণ পুরাতন মোবাইল বিক্রি করা হচ্ছে। মাস্টার কপির অবৈধ মোবাইল ক্রয় বিক্রয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে বা প্রমাণিত হলে মার্কেট কর্তৃপক্ষ ও সমিতি কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এই অপরাধের দায় প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়ভার সমিতি বা মার্কেট কর্তৃপক্ষ নেবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২৩
এনইউ/এসএ