ঢাকা: বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার বিকল্প মডেল দাঁড় করিয়েছেন যিনি, দেশের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত গরিবের ডাক্তার হিসেবেই।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে একুশ শতকের করোনা ভাইরাস মহামারী- এই পুরো পাঁচ দশকেই কোনো না কোনোভাবে আলোচনায় ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাংলাদেশে অনেকেই যাকে সম্বোধন করেন গরিবের ডাক্তার হিসেবে।
তার স্কুল জীবনের সহপাঠী ও পরবর্তীকালে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, চিন্তায় সৎ থেকে দেশের জন্য যেটা ভালো মনে হতো, সেটাই সবসময় করে গেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে জন্মগ্রহণ করা জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন পরিবারের ১০ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী থাকার সময়েই কলেজের দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর ঢামেক ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, তখন থেকেই স্বাস্থ্যখাতের জন্য ভালো কিছু করার জন্য তিনি ছিলেন সবসময় একরোখা, কিন্তু নিজ আদর্শে অটল।
তিনি বলেন, ডাক্তারি পাশের পর আমরা দুজনেই যুক্তরাজ্যে যাই। সেখানে থাকাকালে সার্জারিতে কাজ করে সার্জন হিসেবে সুনাম অর্জন করেন তিনি। '৬৯ সালের ওই সময়ে আমরা সবাই দেশ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। কিন্তু তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) গড়ে তোলেন এবং তার নেতৃত্ব ছিলো বলিষ্ঠ।
ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, 'যুদ্ধকালীন গড়ে তোলেন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। স্বাধীনতার পর বিলেতে না গিয়ে দেশেই সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে শুরু করলেন। গণস্বাস্থ্য- ধীরে ধীরে সারা বিশ্বের স্বীকৃতি পায়। '
ইংল্যান্ডে থাকার সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রকাশ্যে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে বহনকারী যে হেলিকপ্টার হামলার শিকার হয়েছিল, তাতে জাফরুল্লাহ চৌধুরীও ছিলেন একজন আরোহী।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আগরতলার মেলাঘরে তার গড়ে তোলা বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের ধারাবাহিকতাতেই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোগিতায় সাভারে গড়ে তোলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সখ্য ছিল দুই সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এইচ এম এরশাদের সঙ্গেও, যা নিয়ে তিনি আলোচিত-সমালোচিতও হয়েছিলেন।
এমনকি ওষুধ নীতি নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে বহিষ্কারও করা হয় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) থেকে।
ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, তার ওষুধ নীতি বাংলাদেশের ওষুধ খাতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিশেষ করে তার জন্যই আজকের বাংলাদেশে ওষুধ খাতে এতো উদ্যোক্তা।
ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলেন, বিতর্ক বা সমালোচনা যাই হোক, জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার একটি ভিন্ন মডেল দাঁড় করিয়েছেন। যা তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তিনি চিন্তার জগতে পরিবর্তন এনেছেন। আগে চিকিৎসা, ওষুধ বা স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে প্রশ্ন করার চিন্তা করা যেতো না। তিনিই আমাদের এটা শিখিয়েছেন। তিনি ব্যতিক্রমী ধারার সূচনা করেছেন। তার কাজের প্রতীক গণস্বাস্থ্য, যেখানে মানসিক শ্রমের সঙ্গে কায়িক শ্রমের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তিনি।
ছাত্রজীবনে বাম ধারার রাজনীতি করলেও পরবর্তী জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করেননি জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তবে সবসময়ই স্বাধীন রাজনৈতিক মতামতের মাধ্যমে জনমনে প্রভাব ফেলেছিলেন।
সামরিক শাসকদের সময়েই স্বাস্থ্য নীতি, ওষুধ নীতি ও নারী শিক্ষা, এমনকি ওই সময়ে সহজে দেশের মানুষের জন্য পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে সরকারকে রাজি করানো এবং প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণে সরকারকে প্রভাবিত করতে তার ভূমিকা আলোচনায় এসেছে সবসময়।
তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ ও পারিবারিক বন্ধু ড. শাহদীন মালিক বলছেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন একজন বিরল ধরণের নির্মোহ মানুষ।
তিনি বলেন, এক অর্থে অদ্ভূত মানুষ। ঢিলেঢালা শার্ট প্যান্ট। তাঁর পুরোনা বাসায় আসবাবপত্রও পুরোনো। গাড়িটাও পুরোনো। সব মিলিয়ে নির্মোহ একজন মানুষ। পাওয়ার চিন্তা করেননি কখনো। নিজের জন্য কিছু চাননি।
ড. শাহদীন মালিক আরও বলেন, কিন্তু শেষ জীবনে তিনি মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা সবই পেয়েছেন। দেশ ও জাতির জন্য তার অবদান বলে শেষ করা যাবে না।
পঁচাত্তর সালে বাকশালের বিরোধিতা করেছেন আবার পরবর্তীকালে জেনারেল ওসমানী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়ালে তিনি তার হয়েও কাজ করেছেন। পরে ঘনিষ্ঠ ছিলেন বিএনপি ও এর চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও।
পরবর্তীকালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হলে, তাতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। এর মধ্যে আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতির জেরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি বেশ কিছু মামলাতে তাকে আসামিও হতে হয়েছে।
সর্বশেষে করোনাভাইরাস মহামারীতে তিনি ব্যাপক আলোচনায় আসেন তার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত টেস্ট কীট নিয়ে, স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে।
তবে বিতর্ক, সমালোচনা যাই হোক, জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্যখাত নিয়ে চিন্তা ও কর্মের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধ কমিয়ে এনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।
মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাতে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান দেশপ্রেমিক। মৃত্যুর আগে কিডনি জটিলতার পাশাপাশি অন্যান্য বার্ধক্যজনিত রোগও পেয়ে বসেছিল ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শরীরে। তারপরও তিনি ছুটে চলছিলেন নিজের মতোই।
সম্প্রতি, শরীর একদমই খারাপ হয়ে যায়। ভর্তি হন নিজের সার্বক্ষণিক কর্মস্থল নগর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে। সোমবার (১০ এপ্রিল) নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। তার আগে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনোভাবেই রাজি করানো যায়নি। দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে দেশের মাটিতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবেন- এমন সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। সবশেষ, মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাতে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২৩
এইচএমএস/এনএস