ঢাকা: ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতিসত্তার সবচেয়ে বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ। তাইতো বাংলা বর্ষবরণের এই দিনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জড়িয়ে থাকে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া।
শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) পহেলা বৈশাখে শাহবাগ-চারুকলা ঘুরে দেখা যায়, টমটম, খেলনা পাখি, গাড়ি, চরকির মতো নানা বাঙালি খেলনা বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। বৈশাখ উদযাপন করতে আসা ক্রেতারাও এসব খেলনা কিনছেন খুশি মনে। বাঙালি সংস্কৃতির এসব খেলনার শব্দেই মুখরিত হয়ে উঠেছে শাহবাগ ও চারুকলার প্রাঙ্গণ।
শুধু খেলনার শব্দ নয়, পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ একতারা, ডুগডুগি ও বাঙালি বেহালার দেখা মিলছে বৈশাখ উদযাপন করতে আসাদের হাতে হাতে। হাঁটতে-হাঁটতে মনের অজান্তেই এসব বাদ্যযন্ত্রে টু-টাং করে শব্দ তুলছেন তারা।
এক সময় পহেলা বৈশাখে গ্রামে গ্রামে বসতো বৈশাখী মেলা। এসব মেলার অন্যতম আকর্ষণই থাকতো টমটম, ডুগডুগি, খেলনা পাখি, গাড়ি, একতারাসহ নানা ধরনের বাঙালি খেলনা ও বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু এখন আর আগের মতো গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা হয় না। তাই টমটম-ডুগডুগির মতো খেলনা ও বাদ্যযন্ত্রের দেখা পাওয়া যায় না।
তবে প্রতি বছরের মতো এবারও শাহবাগে বৈশাখী মেলায় বিক্রি হতে দেখা যায় এসব খেলনা ও বাদ্যযন্ত্র। বাবা-মায়েরাও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে সন্তানদের কিনে দিচ্ছেন এসব খেলনা ও বাদ্যযন্ত্র। এছাড়া গ্রাম্য মেলার এসব খেলনা ও বাদ্যযন্ত্র পেয়ে শৈশবে ফিরে যেতে দেখা গেছে বড়দেরও। তাইতো কোনো কথা চিন্তা না করে তাদেরও এসব খেলনা ও বাদ্যযন্ত্র কিনতে দেখা গেছে।
শাহবাগ থেকে একটি টমটম গাড়ি কিনেছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শামীম রুদ্র। তিনি বলেন, ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখে আমরা যখন মেলায় যেতাম, তখন টমটম ও গ্রামীণ বিভিন্ন খেলনা কিনে বাড়ি ফিরতাম। এটাই ছিল তখন আমাদের পহেলা বৈশাখের আনন্দ। কিন্তু এখন আর এসব খেলনা পাওয়া যায় না। আজ হঠাৎ শাহবাগে টমটম দেখে শৈশবের স্মৃতি ফিরে এসেছে। তাই কোনো কিছু না ভেবেই কিনে ফেললাম।
চারুকলায় টমটম গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় ছোট শিশু কৃষ্ণা অর্জুন পান্ডেকে। মামা বাপ্পী দেব ও মামী বৃষ্টি দাসের সঙ্গে বৈশাখী উৎসবে এসেছে কৃষ্ণা। জানতে চাইলে বৃষ্টি দাস বলেন, এসব খেলনা আমাদের ঐতিহ্য। আমরা আমাদের ছোটবেলায় এই ধরনের খেলনা পেয়েছি। এখন আর এগুলো পাওয়া যায় না। তাই ছোটরাও যাতে এসব সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, সেজন্য ভাগনেকে এই খেলনা কিনে দেওয়া।
মো. কাউসার নামের এক চাকরিজীবী বলেন, এসব খেলনা আমাদের শৈশবের স্মৃতি। আজকে আবার অনেকটা শৈশবে ফিরে গেছি। সেই স্মৃতি যেন রেখে দেওয়া যায় এবং বাসার ছোটরা যাতে পরিচিত হতে পারে, তাই টমটম কিনেছি।
পাঁচ বছরের ছেলে ওয়াসি মোহাম্মদ ও তিন বছরের মেয়ে ফারিজা ইসলামকে নিয়ে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে এসেছেন সানজিদা কবির। পেশায় তিনি একজন ব্যাংকার। বৈশাখের সাজে তাদের তিনজনকে চারুকলার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এ সময় ছেলে ওয়াসির হাতে ডুগডুগি ও মেয়ে ফারিজার হাতে দেখা যায় একতারা।
জানতে চাইলে সানজিদা করিব বলেন, আমি শিক্ষার্থী থাকাকালে পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুনের মতো বাঙালি উৎসবে যুক্ত হতাম। কিন্তু আমাদের সন্তানরা এখন এগুলো কী, তা-ই জানে না। আজ সকালেও যখন আমি আমার ছেলেকে বললাম, চল মেলায় যাই। তখন সে জিজ্ঞেস করে- মা, মেলা কী? তাই আমার ছেলে-মেয়েরা যাতে আমাদের সংস্কৃতিকে জানতে পারে, পরবর্তীতে ধারণ করতে পারে সেজন্য তাদের মঙ্গল শোভাযাত্রায় নিয়ে এসেছি। পাশাপাশি বাঙালি বিভিন্ন ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে খেলনা ও বাদ্যযন্ত্র কিনে দিয়েছি।
এদিকে বিক্রেতাদের প্রতিটি খেলনা টমটম ৩০ থেকে ৫০ টাকায়, বাঙালি বেহালা ১০০-২০০ টাকায়, একতারা ৫০-৩০০ টাকায়, খেলনা পাখি, গাড়ি ৩০ টাকায়, ডুগডুগি ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
প্রায় ৩০ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে শাহবাগ এলাকায় টমটম গাড়ি বিক্রি করছেন বগুড়ার মো. বাবলু। তিনি বলেন, ৩০ বছর ধরে বাংলা একাডেমি শাহবাগে ফেরি করে টমটম বিক্রি করি। এবার এক হাজার টমটম গাড়ি বগুড়া থেকে নিয়ে এসেছি। প্রতিটি ৩০-৫০ টাকায় বিক্রি করছি। এছাড়া দুর্গাপূজাসহ অন্যান্য উৎসব ও মেলায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় এসব টমটম গাড়ি বিক্রি করি।
কুষ্টিয়া থেকে ডুগডুগি ও একতারা নিয়ে আসা মো. বাদশা বলেন, এগুলো আমাদের ঐতিহ্য। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে শাহবাগে এগুলো বিক্রি করতে আসি। এখানে আমরা লাভ করতে আসি না। আমরা চাই, আমাদের এসব শিল্প-সংস্কৃতি যেন টিকে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৩
এসসি/এনএস