ঢাকা: মাদারীপুরের শিবচরে এক্সপ্রেসওয়েতে গত ১৯ মার্চ সকাল ৭টা ৩৮ মিনিটে গোপালগঞ্জের ইমাদ পরিবহনের একটি বাস রাস্তা থেকে ছিটকে কালভার্টের উইং-ওয়ালে ধাক্কা খায়। ওই ঘটনায় নিহত হয় ১৯ জন ও আহত হয় ২৬ জন।
ওই দুর্ঘটনায় অতিরিক্ত প্রাণহানির পেছনে চালকের অসাবধানতার চেয়ে অপরিকল্পিত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকে দায়ী করা হয়েছে বুয়েটের গবেষণা প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের(এআরআই) গবেষণা প্রতিবেদন টিমের প্রধান গবেষক ড. শামসুল হক বলেন, দুর্ঘটনা হয় বিশৃঙ্খলার জন্য। গতির জন্য দুর্ঘটনা হয় না যদি সুন্দর একটা শৃঙ্খলা থাকে।
টানা গার্ড রেইল না থাকায় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেশি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন করতে হবে (ডব্লিউবিম) থাকলে গাড়ি নীচে পড়তো না ফলে প্রাণহানি কমিয়ে আনতো।
রোববার (১৬ এপ্রিল) বুয়েট কাউন্সিল ভবনে এআরআই গবেষণা প্রতিবেদন দলের প্রধান গবেষক ড. শামসুল হক দীর্ঘ গবেষণা শেষে এক প্রতিবেদনে এসব মন্তব্য করেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৭ সালে আমদানিকৃত অশোক লিল্যান্ডের গাড়িটির ২০১৮ সালে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলেও ২০২২ এর শেষদিকে রুট পারমিট ও রেজিস্ট্রেশন স্থগিত ছিলো।
তবে বাসের অভ্যন্তরীণ এবং বহির্ভাগ ভালো এবং ট্র্যাকিং ডিভাইস ছিলো। তবে গাড়িটির নতুন হলেও টায়ার মানসম্মত নয়, সামনের বাম পাশের টায়ারটি ফাটা ছিল।
যাত্রীর আসন সংখ্যায় ৪০ জনের অনুমোদন থাকলেও অতিরিক্ত ৩ সিট রাখার জন্য পরিবর্তন করা হয়।
আর চালক মধ্যম শ্রেণীর লাইসেন্স নিয়ে ড্রাইভিং করছিলেন। তবে ভারী যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন ছিল।
প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, গাড়ির অতিরিক্ত গতি, চালকের বেপরোয়া চালনা, টায়ার ফেটে যাওয়া, বাস চালকের ক্লান্তি ও তন্দ্রাচ্ছন্নতা, ব্রিজের রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে যাওয়া এবং যান্ত্রিক/ব্রেকের ত্রুটি, মধ্যম শ্রেণীর লাইসেন্স নিয়ে ড্রাইভিং, পথচারীকে আঘাত, আনফিট বাস এবং ভেজা রাস্তা।
প্রতিবেদনে রাস্তা সংলগ্ন সার্ভিস রোডের অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করে নিরাপত্তার ঘাটতি নিয়ে ড. শামসুল বলেন, ক্লিয়ার জোন বা মৃদু ঢাল না থাকা, রাস্তার অন্য প্রান্তের মতো দুর্ঘটনার প্রান্তে টানা গার্ড রেইল না থাকা, রাস্তা ও হার্ড শোল্ডারের মধ্যে উচ্চতার অসামঞ্জস্য ব্যবধান এবং ব্রিজের প্রান্ত ও রাস্তার মধ্যে উচ্চতার অসামঞ্জস্য ব্যবধান।
দুর্ঘটনা কমাতে হলে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হবে
সড়কের বিশৃঙ্খলা দূর করতে পরামর্শ দিয়ে ড. শামসুল হক বলেন, উন্নত দেশে ট্রাক যদি তার লেন পরিবর্তন করে তাহলে পুলিশ ধরবে। ট্রাকের রুট বাম পাশে থাকলেও তারা ডান পাশে চলে আসে। ফলে ডান দিকে গিয়ে ওভারলেপিং করতে হয়।
'ওভারলেপিং করা যাবে না একই রুটে। এতে প্রতিযোগিতা হবে না ট্রিপ বেশি মারার জন্য। এতে চালকেরা প্রতিযোগিতায় নামবে না'।
প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বললেও আমাদের চিন্তা ভাবনা প্রাগৈতিহাসিক মন্তব্য করে অধ্যাপক শামসুল বলেন, রাস্তা উচু করা হচ্ছে কিন্তু কোন রেলিং নেই। শুধু ব্রিজে ব্রিজে দেওয়া হচ্ছে। মনে হয় এই পানিতে পড়লেই ক্ষতি হবে। টানা রেসিং দিতে হবে।
বিদেশ থেকে আসা সড়ক পরমর্শকরা নিম্নমানের মন্তব্য করে তিনি বলেন, দায়সারা কাজ করে যায়। হাইওয়ে বানালে সেফটি ব্যারিয়ার দিচ্ছে না। এখানে শুধু চালকের দোষ না। উন্নত দেশে ব্যারিয়ার না দিলে শাস্তি হয়। শুধু চালক চালক করছি। অন্য কোথাও মনোযোগ নেই। দুর্ঘটনার কারণে কেউ যাবে না।
সড়কের নিরাপত্তা ঘাটতি সম্পর্কে ড. শামসুল বলেন, অনুপযুক্ত স্থানে থামানো, এলোমেলো পথচারী পারাপার, ঢিলেঢালা মনিটরিং সিস্টেম।
গবেষণা প্রতিবেদনে সড়কের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমিয়ে আনতে ৯ টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো-
১. প্রতিটি গাড়িতে একটি ট্র্যাকিং ডিভাইস থাকতে হবে। একইসঙ্গে গাড়ির ড্রাইভারের রোস্টার এবং ড্রাইভিং রেজিস্টার আপলোড কর। এতে চালক ৫ ঘণ্টার বেশি ড্রাইভিং করছে কিনা মনিটরিং করা যাবে।
২. নিরাপত্তার ত্রুটি শনাক্ত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে রোড সেফটি অডিট করা প্রয়োজন।
৩. এক্সপ্রেসওয়েতে অবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন করতে হবে (ডব্লিউ বিম)। এর খরচ প্রতি কিলোমিটারে মাত্র ৭,০০০ টাকা।
৪. এক্সপ্রেসওয়েতে স্ট্যান্ডার্ড ডিজিটালবভেরিয়েবল মেসেজ সাইনেজ স্থাপন করতে হবে।
৫. বাধ্যতামূলকভাবে প্রাক-নিরাপত্তা নিরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন।
৬. আমদানি করা টায়ার এবং টায়ার-সম্পর্কিত উপাদানগুলির গুণমান পরীক্ষা করার জন্য বিএসটিআইকে ধ্বংসাত্মক এবং অ-ধ্বংসাত্মক উভয় ধরনের পরীক্ষা করার সুবিধা দিতে হবে।
৭. যানবাহনের সঠিক লেনে অবস্থান কার্যকর করা।
৮. বাস স্টপেজ ব্যতীত যাত্রীদের বাসে ওঠানামা নিষিদ্ধ করা। পথচারীদের প্রবেশ এবং এলোমেলো ক্রসিং বন্ধ করা।
৯. সঠিক কাগজপত্র ছাড়া অননুমোদিত চালক এবং অযোগ্য বা ত্রুটিযুক্ত যানবাহন থামানো।
বুয়েটের এই গবেষণা দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন- ড. আরমানা সাবিহা হক, শাহনেওয়াজ রাব্বি, ড. সোহেল মাহমুদ, নাজমুল হক, আসিফ রায়হান, মাহবুব তালুকদার, ইমরান উদ্দিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২৩
এনবি/এসএ