ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

নাম থাকলেও মেলেনি ভিজিএফের চাল, ১০ কেজির বরাদ্দে ২ কেজি হাওয়া!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০২৩
নাম থাকলেও মেলেনি ভিজিএফের চাল, ১০ কেজির বরাদ্দে ২ কেজি হাওয়া!

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার গোবরাতলা ও নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) পবিত্র ইদুল ফিতর উপলক্ষে বরাদ্দ দেওয়া ভিজিএফের চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।  

তালিকায় নাম থাকা অনেকেই পাননি ভিজিএফের চাল।

এমনকি নাম না থেকে চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের কাছের অনেক লোকজনই পেয়েছে ভিজিএফের চাল।  

এছাড়া ১০ কেজির জায়গায় চাল ৮-৯ কেজি করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ সুবিধাভোগীদের।

জানা যায়, গোবরাতলা ইউনিয়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ৪২০০ কার্ডধারী পরিবারের মাঝে ৪২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়।  

চলতি মাসের ১৬, ১৭ ও ১৮ এপ্রিল পরিষদ কার্যালয়ে এসব চাল বিতরণ করা হয়। অন্যদিকে  নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজির হোসেন তালিকার বাইরে থাকা তার স্বজন ও লোকজনদের মাঝে টোকেন বিতরণ করে চাল বিতরণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।  

এখানে ৩২৯০ কার্ডধারী পরিবারের মাঝে ৩২ মেট্রিক টনের অধিক পরিমানে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) বিকেলে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, চালের অপেক্ষায় দীর্ঘ লাইন। লাইনে দাঁড়ানো সুবিধাভোগীরা অভিযোগ করেন, প্রত্যেকে একটি কার্ডের বিপরীতে ১০ কেজি চাল পাওয়ার কথা থাকলেও তাদেরকে দেওয়া হয়েছে ৮-৯ কেজি করে। তারা আরও অভিযোগ করেন, তালিকায় নাম থাকলেও চাল পাননি অনেকে। অথচ তালিকায় নাম না থাকলেও চাল পেয়েছেন কেউ কেউ।

 

সে কথা স্বীকারও করেছেন তালিকায় নাম না থাকা ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও প্রভাবশালীদের দেওয়া টোকেনে চাল পেয়েছেন তারা।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিধবা ভাতার সুবিধা পেলেও ভিজিএফের তালিকায় তার নাম নেই। এমনকি এবছর নতুন করে তালিকা হয়নি। ফলে তার নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোন সুযোগও নেই। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চাল পেয়েছেন এক ব্যবসায়ীর দেওয়া টোকেন দেখিয়ে।  

সেই টোকেনে দেখা গেল, গোবরাতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর রয়েছে তবে কার্ডধারীর নাম ঠিকানা বা ওয়ার্ড সম্পর্কিত কোনো তথ্য দেওয়া নেই।  

তিনি জানান, হঠাৎ করেই জেলা শহরের এক ব্যবসায়ী আমাকে কার্ড দিয়ে বলে, এটি দেখিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে চাল তুলতে পারবে। মঙ্গলবার এই টোকেন দেখিয়ে চাল তুলে এনেছি।  

গোবরাতলা ইউনিয়নের বাসিন্দা বা জনপ্রতিনিধি না হয়েই ওই ব্যবসায়ী তাকে কীভাবে ভিজিএফের চাল দিয়েছে, জানতে তিনি এ বিষয়ে জানেন না বলে জানান তিনি।

গোবরাতলা ইউনিয়নের দিয়াড় ধাইনগর গ্রামের স্কুলছাত্র আশিক আলী তার বাবার নামে বরাদ্দ হওয়া চাল নিয়ে ফেরার সময় পরিষদের সামনে থাকা তরমুজের দোকানের ডিজিটাল স্কেলে মাপেন। সেখানে দেখা যায়, ১০ কেজি চালের জায়গায় দেয়া হয়েছে ৮ কেজি ২৭০ গ্রাম।

উপকারভোগী মুনসুর আলী (৬২) জানান, এর আগে কোনো ইদে এমন সরকারি চাল পাইনি। এবারই প্রথম চেয়ারম্যানের লোক আগেরদিন রাতে বাড়িতে এসে একটা টোকেন ধরিয়ে চাল নেওয়ার কথা বলে গেছে। ১০ কেজি বলে চাল দিলেও ইউনিয়ন পরিষদের বাইরে মেপে দেখলাম ৮ কেজির একটু বেশি।

এদিকে চাঁপাই-মহেশপুর গ্রামের দিনমজুর জহুরুল ইসলামের তালিকায় নাম থাকলেও তিনি চাল পাননি।

জহুরুলের মতোই ভিজিএফের তালিকায় নাম থাকলেও চাল পায়নি স্বামী পরিত্যক্তা সুরমা বেগম।

অন্যদিকে নারায়ণপুরেও একই অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে। এখানকার সুবিধাভোগী আব্দুর রাকিব বলেন, সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ১০ কেজি। কিন্তু চাল বাসায় নিয়ে আসার পর মেপে দেখলে ৭-৮ কেজি করে চাল পাওয়া যাচ্ছে।

তরিকুল ইসলাম নামের এক দিনমজুর বলেন, দিয়াড় অঞ্চলে ও পদ্মা নদীর ওপারে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারেন চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা।

আগের বছরের তালিকায় চূড়ান্ত রয়েছে জানিয়ে গোবরাতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রবিউল ইসলাম টিপু বলেন, এবছর নতুন করে এই ইউনিয়নে ভিজিএফের তালিকা হয়নি। যে বরাদ্দ পাওয়া গেছে, তা ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্যদেরকে বিতরণের জন্য বন্টন করে দেওয়া হয়েছে। তাই তালিকার বাইরে নিজেদের লোকদের মাঝে বন্টন করলে স্বাভাবিকভাবেই তালিকায় নাম না থাকা ব্যক্তিরা চাল পাবে।  

এছাড়াও স্থানীয় সাংসদসহ কিছু জনপ্রতিনিধিদের মাঝে কিছু কার্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তারা নিজেদের লোকদের মাঝে সেই কার্ড বন্টন করেছেন, বলেন চেয়ারম্যান মো. রবিউল ইসলাম টিপু।  

তিনি স্বীকার করেন, এমন পরিস্থিতিতে কার্ডধারী কিছু সুবিধাভোগী বাদ পড়তে পারে।  

ওজনে কম দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, প্রশ্নই আসে না। প্রথম দিনে ১৪০০ সুবিধাভোগীর মাঝে ভিজিএফের চাল বিতরণ করা হয়েছে। সেখানে প্রত্যেকে নূন্যতম ৯ কেজি ৫০০ গ্রাম করে পেয়েছেন। কারণ পাটের বস্তায় কয়েক দফা চালের বস্তা উঠানামা করতে গিয়ে চাল পড়ে পরিমাণ কমে যায়।

আর গোবরাতলা ইউনিয়নে ট্যাগ কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আহমেদ আবু আল আমিন জানান, সঠিকভাবে সকল নিয়ম মেনে ভিজিএফের চাল বিতরণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। কোনো অনিয়ম করা হয়নি।

অভিযোগ অস্বীকার করেন নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজির হোসেনও। তার দাবি, কোনো অনিয়ম হয়নি, ওজনে কম দেওয়ার ঘটনাও ঘটেনি। বরং সবল নিয়ম মেনেই নারায়ণপুর ইউনিয়নে ভিজিএফের চাল বিতরণ করা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রওশন আলী বলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ইউনিয়নে একজন করে ট্যাগ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যারা সার্বিকভাবে এসব কার্যক্রম দেখভাল করেন। ওজনে কম দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ১০ কেজির জায়গায় ৮-৯ কেজি চাল প্রদান এবং তালিকা ছাড়াই অন্যদের মাঝে বিতরণ ও তালিকায় নাম থেকেও না পেলে এর বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য, আসন্ন ইদুল ফিতর উপলক্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে মোট ৫৪ হাজার ৯৯৩টি কার্ডে ৫৪৯ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।