টাঙ্গাইল: বহুল আলোচিত এক ধর্ষণ মামলাই পাল্টে দিয়েছে টাঙ্গাইলের রাজনীতির মাঠ। এতে করে পুরো জেলাজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।
তবে এই ধর্ষণ মামলাটি রাজনৈতিক বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ, ধর্ষণ মামলার আসামি গোলাম কিবরিয়ার ছোট ভাই তানভীর হাসান ছোট মনি বর্তমানে টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের এমপি।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে সেই আসন থেকে নৌকা প্রতীক পেতে এমপি ছোট মনির পরিবারের বিরুদ্ধে এ ধর্ষণ মামলা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
টাঙ্গাইলের বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, এই ধর্ষণ মামলাটিকে পুঁজি করে জেলা ও গোপালপুর এবং ভূঞাপুর উপজেলা আ.লীগের একটি গ্রুপ ফায়দা লুটতে তৎপর হয়ে উঠেছে। এতে করে টাঙ্গাইলের শান্ত রাজনীতি আবার অশান্ত করার পায়তারা করছে দলে থাকা এবং দল থেকে বহিষ্কৃতরা।
এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে এমপি ছোট মনি ও মামলার বাদীর পক্ষ থেকে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী জানান, একটি ধর্ষণ মামলা এই শান্ত টাঙ্গাইলকে আবার অশান্ত করার পায়তারা চলছে। যদি ধর্ষণের ঘটনাটি সত্যি হয় তবে অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। তারপরও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ যাতে টাঙ্গাইলকে আবার অশান্ত করার চেষ্টা না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
এদিকে ধর্ষণ মামলায় হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পেয়েছেন গোলাম কিবরিয়া বড় মনি এবং তার স্ত্রী নিগার আফতাব।
মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি মো. ইকবাল কবির ও বিচারপতি একেএম রবিউল হাসানের বেঞ্চ তাদের চার সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করেন।
জানা যায়, গত ৫ এপ্রিল রাতে টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বড় মনির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে এক কিশোরী। মামলায় উল্লেখ করা হয়, গত ১৭ ডিসেম্বর শহরের আদালত পাড়ায় বড় মনির নিজের বাড়ির পাশে একটি ১০ তলা ভবনের চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে নিয়ে তাকে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে কারও কাছে এই ঘটনা প্রকাশ করতে নিষেধ করেন।
মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, এই ধর্ষণের ফলে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এ কথা গোলাম কিবরিয়াকে জানালে তাকে গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য চাপ ও হুমকি দিতে থাকেন।
ধর্ষণ মামলার তারিখ অনুযায়ী ওই কিশোরী প্রায় চার মাসের অন্তঃসত্ত্ব। তবে ডাক্তারি পরীক্ষায় ওই কিশোরী ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা বলে জানা গেছে। এ নিয়ে পুরো জেলা জুড়েই চলছে আলোচনা।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাধায়ক ডা. খন্দকার সাদিকুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) ওই কিশোরীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। রিপোর্ট বলছে, ওই কিশোরী ২৪ সপ্তাহের (ছয় মাস) অন্তঃসত্ত্বা।
তবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা টাঙ্গাইল সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হাবিবুর রহমান জানান, তারিখ কোনো বিষয় নয়, এটা ক্লিনিক্যাল বিষয়। মেডিকেল রিপোর্ট পর্যালোচনা করে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর ডিএনএ টেস্ট করলেই আসল বিষয় বের হয়ে আসবে।
এদিকে ওই কিশোরীর একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি কক্ষে ওই কিশোরীকে একটি মদের বোতলসহ আটক করে স্থানীয় লোকজন।
আরেকটিতে দেখা যায় ওই কিশোরী ইয়াবা সেবন করছেন। পরে ওই কিশোরী তাকে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের স্ত্রীর পরিচয় দেন।
তবে ওই কিশোরীকে চেনেন না বলে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস হোসেন।
অপরদিকে ওই কিশোরীর বড় ভাই জিয়াউল হক জনি তার বোনের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
সেখানে তিনি দাবি করেন, আমার বাবা জেলা পুলিশের আরআই ছিলেন। আমার ছোট বোন যখন পুলিশ লাইন্স আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ত ততদিন সে অনেক ভালো ছিল। সাত-আট বছর আগে থেকে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিশে নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনসহ নানা খারাপ বিষয়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমি ও বাবা-মা প্রতিবাদ করলে আমাদের গালিগালাজ করত। বাসা থেকে টাকা না দিলে নিজের হাতে ও গলায় ছুরি ধরে আত্মহত্যার কথা বলে টাকা আদায় করত। এছাড়াও অনেক যুবকের সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। প্রতিবাদ করলে আমাকে বিভিন্নভাবে মামলার হুমকি দিত।
নেশার টাকা পেতে কারও প্ররোচনায় তার বোন এ মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দিয়েছে বলে দাবি জনির।
তিনি বলেন, সম্প্রতি যার বিরুদ্ধে সে ধর্ষণের মামলা করেছে তিনি আমাদের ফুপা লাগেন। টাকার জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। তিনি আমার বোনের ক্ষতি করবেন, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। তবে পাঁচ মাস আগে আমার বোন সোনিয়া ক্লিনিকে পরীক্ষা করেছিল। সেখানে তার গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ভাইয়ের অভিযোগের বিষয়ে ওই কিশোরী বলেন, আমার ভাই বড় এমপির কাছ থেকে টাকা পেয়ে আমার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছে। আমার নামে যেসব অভিযোগ এনেছে সবই মিথ্যা। আমার ভাই নিজেই মাদকাসক্ত। ডোপ টেস্ট করলে তার প্রমাণ হবে। সে মাদক সেবনের কারণে একাধিকবার কারাভোগও করেছেন।
ঠিক কী কারণে আর কোন ফায়দা লুটতে এমপি ছোট মনির বড় ভাইকে ধর্ষণ মামলায় জড়ানো হলো?
সে প্রশ্নে বর্তমান এমপি তানভীর হাসান ছোট মনি ও তার অনুসারীরা মনে করেন, টাঙ্গাইল-২ আসনের সাবেক এমপি খন্দকার আসাদুজ্জামানের ছেলে খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল ও জেলার কয়েকজন নেতাকর্মী নেপথ্যে থেকে এ ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়াচ্ছেন। কারণ, গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি রোমেল। এবার মনোনয়ন চাইবেন। তাই তিনি ও তার অনুসারীরা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার আসামিদের সঙ্গে আঁতাত করে বর্তমান এমপির পরিবারকে হেয় করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার আসামিদের ধরতে ও শাস্তির দাবিতে মাঠে নামেন সহদোর দুই ভাই গোলাম কিবরিয়া বড় মনি এবং তানভীর হাসান ছোট মনির। সেই সময় দুই ভাইয়ের জনপ্রিয়তা এবং ক্ষমতা বাড়তে থাকে। আর এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অশান্ত টাঙ্গাইল আবার শান্ত হতে শরু করে। এরমধ্যেই গোলাম কিবরিয়া বড় মনি জেলা বাস কোচ মিনিবাস মালিক সমিতির মহাসচিবের দায়িত্ব পান। আর তার ছোট ভাই তানভীর হাসান ছোট মনির ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে টাঙ্গাইল-২ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
জানা যায়, ফারুক আহমেদ ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা হত্যা মামলায় আসামি হন টাঙ্গাইল-৩ আসনের এমপি আমানুর রহমান খান রানা ও তার তিন ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা। বর্তমানে আমানুর রহমান খান রানা জামিনে এবং তার ছোট ভাই সহিদুর রহমান খান মুক্তি কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া অন্য দুই ভাই কাকন ও বাপ্পা দেশের বাইরে আত্মগোপনে রয়েছেন।
আরও পড়ুন >> বড় ভাইয়ের নামে ধর্ষণ মামলা নিয়ে এমপির সংবাদ সম্মেলন
টাঙ্গাইলে আ.লীগ নেতার ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২৩
এসএএইচ