ঢাকা: পুনর্বাসন ছাড়া বসতি উচ্ছেদ মানবাধিকার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতারা।
শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) সকালে গোপীবাগ টিটিপাড়া রেলওয়ে হরিজন ও তেলেগু সুইপার কলোনীর উচ্ছেদ পরিস্থিতি পরিদর্শন শেষে তারা এই মন্তব্য করেন।
এ সময় কলোনীর দুর্গামন্দির চত্বরে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে নেতারা বলেন, পদ্মা সেতু রেলওয়ে প্রকল্পের আওতায় কমলাপুর থেকে যশোর পর্যন্ত পুরো পথের সবখানেই ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ কিংবা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেবল এই কলোনীর বাসিন্দাদের কোনো ধরনের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। চার বছর আগে উচ্ছেদ করা ১১২ পরিবারের তালিকা করা হলেও, এই দীর্ঘ সময়ে তাদের পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া দুঃখজনক। পুনর্বাসন ছাড়া বসতি উচ্ছেদ মানবাধিকারের সুস্পষ্ট পরিপন্থী।
এসময় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেতারা বলেন, নগরী পরিচ্ছন্ন রাখতে যারা কাজ করেন, তাদের ব্রাত্য করে কোনো উন্নয়নই সুফল বয়ে আনতে পারে না। বর্তমান সরকার দেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা শূন্যতে নামিয়ে আনতে আশ্রয়ণ ও গৃহায়ণ প্রকল্পসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এমনকি, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ মানবতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু দুশো বছর ধরে এ দেশে বসবাস করে আসা হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে এই অমানবিক আচরণ অপ্রত্যাশিত। তারা এ দেশের ভোটার, এ দেশের নাগরিক, তাদের উপেক্ষা করে উন্নয়ন কার্যক্রম প্রত্যাশিত নয়।
সমাবেশে নেতারা কমলাপুর স্টেডিয়ামের পার্শ্ববর্তী মানিকনগর কালভার্ট এরিয়ার মাঠে উচ্ছেদ করা হরিজন ও তেলেগু সুইপার পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য আদেবন জানান।
মহানগর পূজা কমিটির সভাপতি মনীন্দ্র কুমার নাথের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. শ্যামল কুমার রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক পদ্মাবতী দেবী, সমবায় বিষয়ক সম্পাদক তপন চক্রবর্ত্তী, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বাপ্পাদিত্য বসু, লক্ষ্মীকান্ত রায়, সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য, যুব ঐক্য পরিষদের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি অমিতাভ বসাক বাপ্পী, ঐক্য পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতা দিলীপ কুমার কর দীপু, গণেশ ঘোষ, গুরুদাস রায়, জহরলাল দেবনাথ, গোপাল রাজবংশী, একলব্য সরকার পলাশ, উৎপল মণ্ডল, অরূপ কুমার কুণ্ডু, হিন্দু লীগের মহাসচিব শংকর সরকার, সনাতন সংগঠনের প্রতিনিধি দেবাঙ্গনা চৌধুরী নদী প্রমুখ।
কলোনীর বাসিন্দাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রাজেন লাল, পারদ লাল, রাজীব দাস প্রমুখ।
সমাবেশ থেকে জানানো হয়, রাজধানীর গোপীবাগ টিটিপাড়া রেলওয়ে হরিজন ও তেলেগু সুইপার কলোনীর শতাধিক পরিবারকে কোনো ধরনের পুনর্বাসন ছাড়াই অমানবিকভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। গত চার বছরের মধ্যে প্রথম দফায় ১১২ পরিবার এবং পরে আরও ২৭ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আরও ৪০ পরিবারকে শিগগিরই উচ্ছেদ করা হবে বলে মৌখিক নোটিশে জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
প্রায় দুশো বছর আগে ১৮৩৫ সালে ভারতের মাদ্রাজ, তেলেগুসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসব পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জাত মেথর হিসেবে বাংলাদেশে আনা হয়। সেই থেকে তারা বংশ পরম্পরায় রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করে আসছে। রেলওয়ের অধীনে কর্মরত হরিজন সম্প্রদায়ের বাস ছিল ফুলবাড়িয়া পুরাতন রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায়। ৪২ বছর আগে সেখান থেকে তাদের টিটিপাড়া রেলওয়ে হরিজন কলোনীতে স্থানান্তর করা হয়। এখানেও তাদের বসবাস কার্যত মানবেতর।
সম্প্রতি পদ্মাসেতু রেলওয়ে প্রকল্পের আওতায় কমলাপুর থেকে যশোর পর্যন্ত রেললাইন এবং তদসংশ্লিষ্ট আন্ডারপাস, ওভারপাস, ডিপো ইত্যাদি নির্মাণকাজের জন্য টিটিপাড়া রেলওয়ে হরিজন ও তেলেগু সুইপার কলোনীর বাসিন্দাদের দফায় দফায় উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে প্রথম দফায় ১১২টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। সেই সময় ওই পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করে তাদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের কোনো ধরনের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ওই সময় সেখানে অবস্থিত পুরাতন শীতলা মন্দিরটিও ভেঙে ফেলা হয়। পরবর্তীতে আরও ২৭ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদের সময় বাধা দিতে গেলে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে তাদের লাঠিপেটাও করা হয়। উচ্ছেদ করা এই ১৩৯টি পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে বাকি অন্যান্য পরিবারের ঘরগুলোতে গাদাগাদি করে থাকছেন। ছোট্ট একেকটা ঘরে দুই থেকে তিন পরিবারের লোকজন নিতান্তই মানবেতর জীবনযাপন করছে।
অতি সম্প্রতি আরও ৪০ পরিবারকে যে কোনো সময় উচ্ছেদ করা হবে বলে মৌখিকভাবে তাদের জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০২৩
আরকেআর/এনএস