খুলনা: খুলনায় অভিনব কৌশলে ছড়িয়ে পড়ছে নানা প্রতারণা ও ছিনতাই। প্রতারণার নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে একটি ভয়ংকর অপরাধী চক্র।
অপরাধ সংগঠিত করতে তারা ব্যবহার করছেন ভয়ংকর মাদক স্কোপোলামিন। অপরাধ জগতে যার পরিচিতি 'ডেভিলস ব্রেথ' বা 'শয়তানের নি:শ্বাস' নামে। শয়তানের নিঃশ্বাস মাদক একটি হেলুসিনেটিক ড্রাগ।
পাশ্চাত্যের এই ভয়ংকর মাদক এখন খুলনার সংঘবদ্ধ একটি অপরাধী চক্রের হাতে। এই চক্রটির টার্গেট হয়ে স্বেচ্ছায় নিজেদের মূল্যবান মালামালসহ টাকা পয়সা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তাদের মূল টার্গেট ইজিবাইক ছিনতাই ও যাত্রীদের মালামাল লুট।
বর্তমানে ছিনতাই ও লুটের নতুন এ পন্থায় খুলনার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এ পন্থায় একজন প্রতারক কিংবা ছিনতাইকারী ভুক্তভোগীকে চাইলেই কাবু করে নিজের ইশারায় নাচাতে পারেন। প্রতারক যে নির্দেশনাই দেবেন, তা-ই অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন সেই নিরীহ ভুক্তভোগী। বিষয়টি জাদু-টোনার মতোই কাজ করে।
খুলনা মহানগরীর শিববাড়ির মোড়, সাত রাস্তার মোড়, ময়লাপোতা, রয়্যাল মোড়, শামসুর রহমান রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় এ চক্রটি সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। কখনও পুলিশ, কখনও যাত্রী আবার কখনও চালক সেজে হাতিয়ে নিচ্ছেন ইজিবাইক, স্বর্ণালংকার, টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। সাম্প্রতিক সময়ে খুলনায় প্রায় ১০টি এমন ঘটনা ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার (৪ মে) দুপুরে কথা হয় এমন এক ঘটনায় ভুক্তভোগী খালিশপুরের ইজিবাইক চালক মো. রাতুলের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ১১ এপ্রিল জীবন বীমা করপোরেশনের সামনে থেকে আমার ইজিবাইকটি নিয়ে গেছে। ওইদিন সাতরাস্তা মোড় থেকে একজন যাত্রী ইজিবাইকে ওঠেন। তেঁতুলতলা মোড়ে আসতেই তিনি ইজিবাইকটি থামাতে বলেন। এ সময় পেছন থেকে একটি সাদা প্রাইভেটকার আসলে ইজিবাইকে থাকা যাত্রীটি নেমে যান ও প্রাইভেটকারে থাকা এক ব্যক্তি আমার ইজিবাইকে ওঠেন। ওই যাত্রী আমাকে চেনা চেনা লাগছে বলে তার হাত দিয়ে আমার মুখে থাকা মাস্কটি টেনে খুলে দেন। এরপর থেকে আমি বেহুশ হয়ে পড়ি। তিনি আমাকে যেদিকে যেতে বলেছেন, আমি সেদিকেই গিয়েছি। একপর্যায়ে আমাকে মারধর করে রাস্তায় ফেলে ইজিবাইক নিয়ে যান।
তিনি আরও বলেন, এখন এসএসসি পরীক্ষা চলছে। ইজিবাইক ছিনতাই হওয়ার পর থেকে অনেক অর্থকষ্টে আছি। এ বিষয়ে বড় ভাই অনেক ছোটাছুটি করছেন। তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না। আমরা থানায় আবেদন করেছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এই একই কায়দায় আমাদের খালিশপুরের আরও চারটি ইজিবাইক নিয়ে গেছে প্রতারক চক্রটি। তারা প্রাইভেটকার থেকে নেমে ইজিবাইক নিয়ে চলে যায়।
রাতুলের বড় ভাই আসিফ রহমান রাফি বাংলানিউজকে বলেন, আমার ছোট ভাইয়ের ইজিবাইক হারানোর পর থেকে আমি ফুটেজ সংগ্রহ করেও কোনো সমাধান পাচ্ছি না। থানায় গেলে এখানে যেতে বলে, সেখানে যেতে বলে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
গত ৮ এপ্রিল এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন খুলনার লবণচরা এলাকার বাসিন্দা আকলিমা আক্তার আঁখি।
তার চাচাতো ভাই আল-আমিন সিকদার বাংলানিউজকে বলেন, তিনটা চেইন ও এক জোড়া কানের দুল নিয়ে আঁখি হেলাতলে যাচ্ছিল ইজিবাইকে। জাতিসংঘ পার্কের সামনে থেকে অপর এক যাত্রী ওঠেন। ইজিবাইকে থাকা ওই যুবক একটি কাগজ বের করে অপর একজনকে বলেন, এই কাগজে কি লেখা আছে, আপনি কি পড়ে আমাকে জানাতে পারবেন? তখন তিনি বলেন আমি লেখাপড়া জানি না। এরপর আমার বোন আঁখিকে বলে এই কাগজে কি লেখা আছে? আপনি একটু পড়ে দেবেন। তখন কাগজ হাতে নিয়েই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তারা তাকে বলে কাছে যা আছে দিন। আঁখি তার কাছে থাকা তিনটি স্বর্ণের চেইন ও এক জোড়া কানের দুল তাদের হাতে তুলে দেন। তারা আঁখিকে শহীদ হাদিস পার্কের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। কিছুক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরে আসে। এ ঘটনায় মহানগরীর সদর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে আমি দুইজন আসামিকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে কৌশলে তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেই। এ ঘটনায় তামিম ও সুমন নামের দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু মূলহোতা জাহিদ এখনও ধরা পড়েনি।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি বিএল কলেজের এক ছাত্রী আযম খান কমার্স কলেজে পরীক্ষা দিতে আসার সময় পথে তার সঙ্গে থাকা অন্য এক যাত্রী মুখের সামনে রুমাল ধরেন। এতে তিনি নিজের হুশ হারিয়ে তার কথা মতো স্বেচ্ছায় গলার চেইন ও কানের দুল খুলে দিয়ে দেন প্রতারকদের।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, 'ডেভিলস ব্রেথ' বা 'শয়তানের নি:শ্বাস' থেকে বাঁচতে মানুষকে সচেতন থাকতে হবে। অচেনা বা সন্দেহজনক ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো জিনিস খাওয়া বা পান করা যাবে না। রাস্তায় বা হোটেলে খাবার খাওয়ার সময় খাবার উন্মুক্ত রেখে কোথাও যাওয়া যাবে না। অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে হ্যান্ডসেক করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অচেনা ব্যক্তি গ্লাভস পরা থাকলে কোনো মতেই হ্যান্ডসেক করবেন না। ভ্রমণের সময় অচেনা বা সন্দেহজনক ব্যক্তির ব্যবহার করা কোনো বস্তু নিজে হাত দিয়ে ধরা যাবে না। অচেনা কেউ ঠিকানা বা প্রেসক্রিপশন দেখে দিতে বললে এড়িয়ে চলতে হবে। কোনো ফুল বিক্রেতার ফুলের ঘ্রাণ নেওয়া যাবে না। অচেনা জায়গায় ঘুরতে গেলে, কোনো রুমে থাকা অবস্থায় মশা নিধনকারী স্প্রে বা এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে ব্যবহার করা যাবে না।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (সাউথ) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ইজিবাইক চুরি, প্রতারণা করে মালামাল লুটের অভিযোগ পাওয়ার পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্ত করা হয়েছে। এ চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। সাদা প্রাইভেটককারের মালিককে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। আশা করছি অচিরেই সবাই ধরা পরবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৭ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০২৩
এমআরএম/এসআইএ