যশোর: যশোরের কেশবপুরে চিন্ময় কর্মকার নামে এক শিক্ষিত যুবক বাবার কামারশালায় নিজস্ব আধুনিক প্রযুক্তির মেশিন ব্যবহার করে কৃষি কাজের যন্ত্রপাতি ও গৃহস্থালির যাবতীয় লৌহজাত যন্ত্রপাতি তৈরি করে সাড়া ফেলেছেন। এতে সময় ও শ্রম দুটোই যেমন সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি দ্রুত সময়ের মধ্যে লোহার যন্ত্রপাতি তৈরি করা যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কেশবপুর পৌর শহরের পশু হাসপাতালের পাশেই আনন্দ কামারশালা। বহু পুরাতন পদ্ধতি কয়লার আগুন ও হাতে টানা পাম্পে হাওয়া দিয়ে লোহা পুড়িয়ে টং-ঠাং শব্দে যন্ত্রপাতি তৈরির শব্দ নেই। সেখানে এখন বৈদ্যুৎ চালিত আধুনিক মেশিনে দা, বটি, কুড়াল, শাবল, কাঁচি, পাসনীসহ প্রয়োজনীয় সকল কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়। এছাড়া রাজমিস্ত্রিদের জন্য কন্নিক, নাকচেরা, হ্যান্ডেল ও ছাদের ফানুসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও তৈরি করা হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক আনন্দ কর্মকারসহ তার ৫ পুরুষ কামারশালাটি পরিচালনা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্তমানে তিনি কেশবপুর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা হলেও তার পূর্বপুরুষের বাড়ি মণিরামপুর উপজেলার রসূলপুর গ্রামে। ওই গ্রামেই তার তিন পুরুষরা ১৪৮ বছর ধরে কর্মকারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। বিগত দিনে আনন্দ কর্মকারের তিন পূর্বপুরুষ মারা গেলেও তিনি এবং তার ছেলে চিন্ময় কর্মকার তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা আজও ধরে রেখেছেন।
তবে প্রচণ্ড আগুনের পাশে বসে পরিশ্রম করে এ পেশায় টিকে থাকা খুবই দূরহ হয়ে দাড়িয়েছিল। এতে আনন্দ কর্মকারের ছেলে চিন্ময় কর্মকার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কামারশালাটি পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে। সে মোতাবেক ২০২১ সালে পুরাতন এনালক পদ্ধতি বাদ দিয়ে তাদের কামারশালার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর কিছু দিনের মধ্যে তিনি তার নিজস্ব প্রযুক্তির প্রাথমিক ব্যবহার শুরু করে উপকৃত হতে শুরু করেন। এরমধ্যে রয়েছে, পাওয়ার হ্যামারিং মেশিন, রড ব্যান্ডিং ও অটো হাওয়ার মেশিন।
আনন্দ কর্মকার বাংলানিউজকে বলেন, আগুনের পাশে বসে বড় হাতুড়ি দিয়ে লোহা পিটিয়ে শরীরের ঘাম ঝরানো লাগছে না। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে অতিরিক্ত শ্রমিক ছাড়াই দক্ষতার সঙ্গে নিজেই কাজগুলো করতে পারছি। এতে মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি কাজের ওপর আরও আগ্রহ বেড়েছে। ইতোপূর্বে কামারশালায় লোহা পিটানোর শ্রমিক পেতে বেগ পেতে হতো। দুইজন শ্রমিক ছিল প্রতিমাসে তাদেরকে প্রায় ২৫ হাজার টাকা দিতে হতো। এছাড়া হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ১টি দা তৈরি করতে সময় লাগতো ৭/৮ ঘণ্টা। এখন আধুনিক মেশিনে ১টি দা তৈরি করতে সময় লাগছে মাত্র ১ ঘণ্টা। এরফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতিমাসে সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা।
আনন্দ কর্মকার আরও বলেন, তার পূর্ব পুরুষদের এ পেশার মধ্যেই জীবন-জীবিকা কেটেছে, লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। তবে ছেলে চিন্ময়কে তিনি পড়াশুনা করিয়েছেন। চিন্ময় হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে কেশবপুর কলেজ থেকে অনার্স পাশ করেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি চিন্ময় তার বাবার দোকানে প্রায় ১০ বছর কর্মকারের কাজ করে আসছেন। এরই মধ্যে উচ্চ শিক্ষত চিন্ময় ২০২১ সালে তার মাথায় আসে হাতুড়ি দিয়ে লোহা পিটিয়ে আর কতকাল বাবা শরীরের ঘাম ঝরাবেন! এরপর প্রায় ৩ মাস রাত-দিন প্রযুক্তি নিয়ে চেষ্টা করে নিজস্ব ভাবনায় ডিজিটাল মেশিন আবিস্কার করেন।
আধুনিক কামারশালা উদ্ভাবক চিন্ময় কর্মকার বলেন, ছোট বেলায় বাবা ও দাদুর হাতুড়ি দিয়ে লোহা পেটানো দেখে আমার খুবই কষ্ঠ লাগতো। তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি আমি আমাদের কামারশালার জন্য আধুনিক মেশিন আবিস্কার করার সিদ্ধান্ত নিই। পরবর্তিতে কেশবপুর বাজারের ফিরোজের লেদ থেকে তার সহযোগীতায় ডিজিটাল পাওয়ার হ্যামারিং ও রড ব্যান্ডিং মেশিন তৈরি করি। এসব ম্যাশিন বিদ্যুৎ চালিত। এতে বিদ্যুৎ খরচও অনেক কম। বর্তমানে এই আধুনিক মেশিন দিয়েই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে কৃষক ও এলাকার মানুষের গৃহস্থালির সকল যন্ত্রপাতি তৈরি করছি। তাতে জিনিসের মানও ভাল হয় এবং সময় এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৪ ঘণ্টা, মে ০৯, ২০২৩
ইউজি/ এসএম