রাজশাহী: ডা. আব্দুস সামাদ; এক প্রচারবিমুখ ব্যক্তি। যিনি দীর্ঘ ২৫ বছরেরও বেশি সময় থেকে গরিব মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন নীরবে নিভৃতে।
আগে ভাড়া ভবনে রোগী দেখতেন। পরে রাজশাহী শহরের জনবহুল শিরোইল কলোনি এলাকায় থাকা নিজের ছোট্ট বাড়ির নিচ তলাতে প্রয়াত স্ত্রীর নামে গড়ে তুলেছেন ‘সাবেরা মেমোরিয়াল ডায়াবেটিস সেন্টার’। এখন সেখানেই চলে তার চিকিৎসা কার্যক্রম। দিনের দুই ভাগে প্রতিদিনই দুই শতাধিক রোগীকে বৃদ্ধ বয়সেও চিকিৎসাসেবা দেন তিনি। শুধু চিকিৎসাই নয়, সমাজের দুস্থ ও অসহায় রোগীরা বিনামূল্যে ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ওষুধও পান তার কাছ থেকে।
সাবেরা মেমোরিয়াল ডায়াবেটিস সেন্টারে গিয়ে কথা হয় মটপুকুর এলাকার পঞ্চাশোর্ধ শেফালী বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, এখান থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন তিনি। এক-দুই বছর নয়, টানা পাঁচ বছর ধরে এখানে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। লোকমুখে প্রথম যেদিন জেনেছিলেন তখন বিশ্বাস হয়নি শেফালীর। তবে সেবা নিতে এসে দেখেন ঘটনা সত্য। এখানে দুস্থ মানুষ বিনামূল্যেই সেবা পান। টাকা না থাকলে অনেক মানুষকে প্রয়োজনীয় ওষুধও দেওয়া হয় বিনামূল্যে। শহরের অন্যান্য প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডাক্তারের চেম্বার ছেড়ে অনেকে তাই এই কলোনি এলাকায় এসে চিকিৎসা নেন।
কেবল শেফালী বেগম নন, এখানে আসা অসচ্ছল রোগীদের সবার ভাষ্য কমবেশি এমনই। প্রতিদিন তাই রোগীর চাপ থাকে এখানে। অনেক সময় রোগীরা চিকিৎসা নিতে ডা. আব্দুস সামাদের বাড়ির বাইরেও দাঁড়িয়ে থাকেন। কারণ অসচ্ছল রোগীর পাশাপাশি সামর্থ্যবানদের চিকিৎসকও তিনি।
সাবেরা মেমোরিয়াল ডায়াবেটিস সেন্টারে গিয়ে দেখা যায় মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে ২/৩ বছর ধরে এখানে সেবা নিচ্ছেন একেক জন সচ্ছল রোগী। বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি এমন রেজিস্ট্রেশনকারী রোগী রয়েছেন ডা. আব্দুস সামাদের। যাদের অধিকাংশই ডায়াবেটিস রোগী এবং তারা কেউ কেউ সাত দিন, ১০ দিন, ১৫ দিন এবং এক মাস পর পর নিয়মিত চিকিৎসা নিতে এখানে আসেন। প্রতিবার মাত্র ১৫০ টাকা (ডায়াবেটিস কিট বাবদ) দিয়ে ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার, ওজন ও ইউরিনের পরীক্ষা করাতে পারেন।
ভিজিট ফি নেন না ডা. আব্দুস সামাদ। দরিদ্রদের বিনামূল্যে ডায়াবেটিস ও মেডিসিন রোগের সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেন তিনি। এই চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রে সামর্থ্যবানদের জন্য ৩০০ টাকা ভিজিট নির্ধারণ করা আছে। যদিও তার এখানে বেশির ভাগ রোগীই নিম্ন আয়ের। তাই ওই ‘ফি’ কেবল কাগজে-কলমেই নির্ধারণ করা আছে। প্রতিদিন হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাস্তবে প্রায় সব রোগীই ‘ফ্রি’ চিকিৎসা নিয়ে থাকেন ডা. আব্দুস সামাদের কাছে।
কেবল তাই নয়, সমাজের অস্বচ্ছল রোগীদের কথা চিন্তা করে আব্দুস সামাদ সেন্টারেই গড়ে তুলেছেন একটি মিনি ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। যেখানে প্রাথমিকভাবে সবাই রক্ত, ইউরিন, ইসিজিসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারেন খুব অল্প খরচেই।
সাবেরা মেমোরিয়াল ডায়াবেটিস সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক মো. লাল মোহাম্মদ জানান, তাদের এই ডায়বেটিস সেন্টারে লিপিড প্রোফাইল, কিডনি ফাংশন, লিভার ফাংশন, জন্ডিস, হিমোগ্লোবিন ও ইসিজিসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়।
তিনি বলেন, এখানকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ খুবই কম। তাই অন্যান্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাবের মতো তাদেরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার চাপ থাকে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা এখানে টাকা দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। আর যাদের সামর্থ্য নেই ডা. আব্দুস সামাদের নির্দেশনায় তাদের বিনামূল্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
সব শ্রেণির মানুষের ভালোবাসসহ নানান কারণে এটি মূলত এখন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যেখানে সেবাই মুখ্য বলেও উল্লেখ করেন সেন্টারের এই তত্ত্বাবধায়ক।
কথা হয় গরিবের ডাক্তার খ্যাত প্রচারবিমুখ মানুষ আব্দুস সামাদের সঙ্গে। তিনি জানান, অর্থের জন্য নয়, মানুষকে সেবা করার জন্য তিনি চিকিৎসক হয়েছিলেন। সেই ছোট্টবেলা থেকেই তার ব্রত ছিল মানবসেবা করার। এজন্য মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই অনেক ত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি ১৯৯৩ সালে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর ডায়াবেটিসসহ তিনি বিভিন্ন চিকিৎসায় আরও ডিগ্রি ও দক্ষতা অর্জন করেন। এরপর চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত হন। জীবনের প্রথম ভাগে তার কাছে সরকারি চাকরি করার জন্য অফুরন্ত সুযোগ এসেছে। কিন্তু তিনি মানবসেবার উদ্দেশে সরকারি চাকরিতে যোগ দেননি।
ঢাকার বারডেমে এক বছর সংযুক্ত থেকে পরে নাটোর ডায়াবেটিস সমিতিতে মেডিকেল অফিসার হিসেবে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন আব্দুস সামাদ। সেখানে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেবা কার্যক্রম চালান। এরপর তার বন্ধুরা নাটোরে ‘ইব্রাহিম ডায়াবেটিস’ সেন্টার খোলেন। পরে সেখানে চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করেন তিনি। আর শুরু থেকেই তিনি এর পাশাপাশি নিজের এলাকায় ভবন ভাড়া নিয়ে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা দিতে থাকেন। এরপর মানুষের স্থান সংকুলান করতে না পারায় নিজ নিজের বাড়ির নিচতলাতেই চেম্বার খোলেন গরিবের ডাক্তার সামাদ।
এরই মধ্যে ২০১৫ সালের তার স্ত্রী সাবেরা বেগম মারা যান। এরপর তার স্ত্রীর প্রতি সম্মান জানিয়ে বাড়ির নিচতলাতেই বড় পরিসরে ‘সাবেরা মেমোরিয়াল ডায়াবেটিস সেন্টার’ খোলেন। এতে ওই সেন্টারের পরিধি বাড়ে। চিকিৎসা সেন্টারের মধ্যে একটি ল্যাব ও ডায়াগনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারও চালু করেন তিনি। যেখানে নামমাত্র মূল্যে সব শ্রেণির মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারেন। আগে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার কেশরহাটে সপ্তাহে একদিন তিনি ‘হেলথ ক্যাম্প’ করতেন। কিন্তু এখন বয়স বেড়ে যাওয়ায় এবং সেন্টারে রোগীর চাপ বাড়ায় মোহনপুরে আর যেতে পারেন না। তাই ওই হেলথ ক্যাম্প এখন বন্ধ।
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. আব্দুস সামাদ বলেন, অর্থই সাফল্যের মাপকাঠি নয়। মানুষকে সেবা করার মধ্যে তিনি যে সুখ খুঁজে পান তা অর্থের চেয়েও বেশি। সবাই তার জন্য প্রাণভরে দোয়া করে। এটাই তার চিকিৎসক জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। প্রফেসর ডা. ইব্রাহিমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি যেই সেবা কার্যক্রম শুরু করেছিলেন, তা আজ অনেকাংশেই পূরণ হয়েছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাধারণ মানুষের সেবা করতে চান বলে জানান ডা. আব্দুস সামাদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৬ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০২৩
এসএস/এমজেএফ