ঢাকা: ছোট ভাই হত্যার বিচার চাওয়ায় ভাঙাচোরা অস্ত্র দেখিয়ে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান।
রোববার (২৮ মে) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন অভিযোগ করেন।
হাবিবুর রহমান মিজান বলেন, ১৯৯৬ সালের ৭ মে ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই হত্যা মামলায় আদালত আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফের ফাঁসি ও জোসেফের ভাই হারিস আহমদ ও আনিস আহমদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
ভাই হত্যার বিচার চাওয়াই আমার কাল হয়েছিল। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সরাসরি ইন্ধনে আমাকে ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ আমার নামে এর আগে একটা মামলাও ছিল না। আমি মুক্তি পেলেও এখনও নিরাপত্তা শঙ্কায় ভুগছি। আমি কখনও ভাবিনি আপনাদের সামনে আবার দাঁড়াতে পারবো।
রাজধানীর কাকরাইলের একটি দোকানে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল জমা রাখার প্রমাণ স্বরূপ একটি কাগজ দেখিয়ে তিনি বলেন, আমার অত্যাধুনিক লাইসেন্স করা পিস্তল ছিল। যেটি আমি ২০১৮ সাল থেকে কাকরাইলে একটি পিস্তলের দোকানে জমা রেখেছি। এরপরও আমার কেন ভাঙাচোরা অস্ত্র লাগবে? কিন্তু আমার কাছ থেকে একটি ভাঙাচোরা অস্ত্র উদ্ধার দেখিয়ে র্যাব আমাকে গ্রেপ্তার দেখায়। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ আমার সঙ্গে ক্যাসিনোকাণ্ডের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
তার দাবি, একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সরাসরি ইন্ধনে তাকে গ্রেপ্তার করানো হয়। গ্রেপ্তারের সময় তার বাসা থেকে দলিলপত্র, টাকা ও স্বর্ণালংকার জব্দ করা হলেও জব্দ তালিকায় তা উল্লেখ করা হয়নি। আজও তিনি সেসব ফেরত পাননি।
তিনি বলেন, আমি হাবিবুর রহমান মিজান মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। আমি বঙ্গবন্ধুর একজন অনুগত কর্মী। আমি ফ্রিডম মিজান নই। ফ্রিডম মিজান সাজাপ্রাপ্ত আসামি। যিনি এখন জেলে আছেন।
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালের ৭ মে মোহাম্মদপুরে আমার ভাই মোস্তাফিজুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই হত্যা মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফকে মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার জজ আদালত। সেই রায়ের বিরুদ্ধে জোসেফ আপিল করলেও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। পরে আপিল বিভাগ এ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সেই মামলায় আরও আসামি ছিলেন জোসেফের ভাই হারিস আহমদ ও আনিস আহমদ। যারা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। হারিস ও আনিস রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা পেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এমনকি সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও তাদের কারাগারে যেতে হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে এখনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে।
আমার ভাই খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফও রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার পর কারাগার থেকে মুক্তি পান ২০১৮ সালের মে মাসে। বড় ভাই হারিস আহমেদের হাত ধরে রাজনীতির মাঠে আসেন জোসেফ। এক সময় জাতীয় পার্টির রাজনীতি করতেন হারিস। নব্বই দশকে জাতীয় পার্টি ছেড়ে হারিস দল বদল করেন। বড় ভাইয়ের ক্যাডার বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন জোসেফ। ওই সময় মোহাম্মদপুর-হাজারীবাগসহ আশপাশের এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন জোসেফ। যোগ দেন আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আলোচিত সেভেন স্টার গ্রুপে। জোসেফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখনও চলছে।
২০১৯ সালে পরিবর্তিত এক পরিস্থিতিতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় আমাকে আটক করা হয়। যদিও এর আগে আমার নামে কোনো থানায় কখনও কোনো মামলা ছিল না। ওই সময় আমার বিরুদ্ধে সাজানো সব অভিযোগ আনা হয়। এমনকি আমার নামও বদলে দেওয়া হয়। আমার নাম দেওয়া হয় মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান। অথচ আমার নাম হাবিবুর রহমান মিজান। সরকারের ওই অভিযান ছিল ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। অথচ এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডে আমি সম্পৃক্ত না থাকলেও সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রভাবশালীর নাম জানতে চাওয়া হলেও তিনি তা উল্লেখ না করে বলেন, একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সরাসরি ইন্ধনে ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ, হারিস ও আনিসের মদদে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নিজে ফ্রিডম পার্টির মিজান নন দাবি করে তিনি বলেন, যে ফ্রিডম মিজানুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছেন, তার নামে আমার পরিচয় দেওয়া হয়। ওই সময়ের বিভীষিকা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। আমাকে গ্রেপ্তারের মূল কারণ ছিল সন্ত্রাসী জোসেফ গংরা মোহাম্মদপুর এলাকায় আবারও তাদের পুরোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করা। অথচ আমার ভাই হত্যায় তার ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনায় জোসেফ অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি ভালো হয়ে গেছেন, আর কোনোদিন কোনো খারাপ কাজ করবেন না। বাস্তবে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা তার এক আপনজনের সরাসরি সহযোগিতায় আমার ওপর নৃশংসতা চালায় তারা।
সাজানো ও মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয় দাবি করে মিজান বলেন, ২০২০ সালে আমার স্ত্রী মনি রহমান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আমি তার মরা মুখটাও দেখতে পারিনি। আমার মা মারা যান। বড় বোনের জামাই ও অনেক আপনজন মারা গেলেও তাদের ধর্মীয় বিদায়ে আমি অংশ নিতে পারিনি, যা এক ভয়ংকর দুঃসময় ছিল আমার জন্য। যে ভয়ংকর সময় আমি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার মাথার ওপর এখনও ঝুলছে কথিত অর্থপাচার ও অবৈধ অস্ত্র মামলা। যার সঙ্গে আমি কোনোভাবেই সম্পৃক্ত না।
মিথ্যা মামলায় হয়রানির প্রতিকার দাবি করে সাবেক এ প্রভাবশালী কাউন্সিলর বলেন, তিন বছরের বেশি কারাভোগের পর ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর মুক্তি পাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি। মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে সব সময় মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছি। এটাই আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ ও তার প্রভাবশালী শক্তি আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। আমার সাজানো-গোছানো জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে। আমি অবিলম্বে এ সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর গ্রেপ্তার দাবি করছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০২৩
পিএম/আরবি