গাইবান্ধা: গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর থেকে পীরগঞ্জের দিকে খানিক এগোলেই জামালপুর বাজার। বাজার পার হয়ে মিনিট দুয়েকের পথ যেতেই দেখা গেল হাতের বাঁয়ে মানুষের বেশ ভিড়।
বাড়ির উঠানে শামিয়ানা টানানো। কিছু চেয়ার পাতা আছে পেছনের দিকে। সামনের পুরো অংশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নতুন ২০টি সেলাই মেশিন। প্রতিটি মেশিনের পাশেই একজন করে বসে আছেন।
তাদের মধ্যে কিশোরী, মাঝ বয়সী, বিধবা ও অসচ্ছল নারীরা আছেন। সব সময়ই দারিদ্র্যের ছাপ লেগে থাকা এই মুখগুলো আজ অনেকটাই হাস্যোজ্জ্বল। বেশ আনন্দের একটা ভাব তাদের মধ্যে লক্ষ করছিলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে কথা হয় রিতুর সঙ্গে।
অসুস্থ হয়ে বাড়িতে বেকার পড়ে আছেন রিতুর বাবা রেজাউল করিম। ছোটখাটো কাজ করে ১০ জনের সংসার আর চালাতে পারছেন না তার মা মরিয়ম বেগম। একরকম হাত পেতে, ধার-দেনা করে এইচএসসি পাস করেছেন রিতু আক্তার। এখন ডিগ্রিতে (বিএ) ভর্তি হবেন। কিন্তু অভাব এখন বাদ সেধেছে, কোনো রকমভাবেই টাকার জোগাড় করতে পারছিলেন না।
সেলাই মেশিনকেই নিজের অবলম্বন করতে চান রিতু। শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এসে সেলাইয়ের কাজ শিখছেন প্রতিদিন। সেলাইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে বুনন করছেন একেকটি স্বপ্ন। রিতু বললেন, ‘বিএ পাস করতে পারলে একটি চাকরি জোগাড় করে নিতে পারব। তার আগের সময়টাই অনেক কঠিন। বসুন্ধরা গ্রুপ আমাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। আমি এটি কাজে লাগাতে চাই। ’ কীভাবে কাজে লাগাতে চান জিজ্ঞেস করতেই রিতুর উত্তর, ‘যখনই জানতে পেরেছি শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আর দেরি করিনি। ভর্তি হয়ে প্রতিটি ক্লাসে উপস্থিত থেকেছি। হাতে সেলাই করে বেশ কিছু কাপড়ও বানিয়েছি। এখন শুধু সেলাই মেশিনের প্রয়োজন ছিল। এই অভাব দূর করে দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। আজকে আমার হাতে নতুন সেলাই মেশিন তুলে দেবে তারা। আমি নিশ্চিত, এখন আর অভাব আমাকে তাড়া করে বেড়াতে পারবে না। আমাকে স্বাবলম্বী করল বসুন্ধরা গ্রুপ। ’ শুধু রিতু নন, তার মতো আও ১৯ জনের স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ।
গত শুক্রবার (২৬ মে) গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের জামালপুর গ্রামের ২০ অসচ্ছল নারীর হাতে সেলাই মেশিন তুলে দেওয়া হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে নারীদের হাতে সেলাই মেশিনগুলো তুলে দেন কালের কণ্ঠ’র প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন।
শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামানের সভাপতিত্বে এ সময় উপস্থিত ছিলেন- সাদুল্যাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহরিয়া খান বিপ্লব, জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহিদ হাসান মণ্ডল শুভ, জামালপুর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম, সাদুল্যাপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি তাজুল ইসলাম প্রমুখ।
শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বেশ কিছুদিন থেকেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন এ ২০ নারী। তারা এখন অনেক রকম জামাকাপড় কাটতে ও সেলাই করতে জানেন। প্রতিদিনই সেলাইয়ের ফোঁড়ে স্বপ্ন বুনছিলেন তারা। আজ তাদের সেই স্বপ্নপূরণের দুয়ার খুলে দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রিশা আকতারের পরিবারের অবস্থাও খুব শোচনীয়। গাছ থেকে পড়ে শ্রমিক বাবা রশিদুল ইসলামের একটি পা অকেজো হয়ে যায়। স্থানীয় রাইস মিলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাজ করেন তিনি। মা রেখা বেগম মাটি কাটা শ্রমিকের কাজ করেন। রিশা সংসারের জন্য কিছু করতে চায়। বসুন্ধরা গ্রুপ শুভসংঘের মাধ্যমে সেলাই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে জেনে সে ছুটে এসেছিল। তাকে সুযোগ করে দেওয়ায় সে সবার জন্য দোয়া করে বলল, ‘জীবনে একটা বড় সুযোগ এসেছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করে স্বাবলম্বী নারী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে চাই। নতুন মেশিন পেয়েছি। এখন অনেক কাজ পাব। ভালো রোজগার হবে। নিজে পড়াশোনার পাশাপাশি মা-বাবাকে সহায়তা করতে পারব। আমি একসময় নারী উদ্যোক্তা হতে চাই। ’ রাবেয়া বসরীও পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। কাপড়ে, কথাবার্তায় দারিদ্র্যের ছাপ। তবে মেয়েটির অসীম সাহস। অকপটে জানাল, বাবা ওয়াজেদ আকন্দ বর্গাচাষি আর মা গৃহকর্মীর কাজ করে কোনো রকমে পাঁচ সদস্যের পরিবার চালান। তারা দুই ভাই-বোন। টাকার অভাবে পড়াশোনা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। টুকটাক সেলাইয়ের কাজ জানে রাবেয়া। এখন আরেকটু শিখতে পারলেই সেলাইয়ের কাজ করে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় রাবেয়া। তাই সে এসেছে বসুন্ধরা গ্রুপের অর্থায়নে পরিচালিত শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে। এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাস করতে পারলে বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে একটি নতুন সেলাই মেশিন দেওয়া হবে, কার কাছে যেন এই কথা শুনেছে রাবেয়া। এর পর থেকেই এখানে তার নিত্য যাওয়া-আসা। খুবই মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। এমন ইচ্ছাই রাবেয়াকে নিয়ে এসেছে শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। আজ থেকে তার সেই স্বপ্নরা ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। এখন সে একটি সেলাই মেশিনের মালিক। সেলাই মেশিন হাতে পেয়ে তার সে কী আনন্দ। চোখেমুখে লেগে থাকা দারিদ্র্যের ছাপটিও যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে। আত্মবিশ্বাস ভরা কণ্ঠে রাবেয়া বলে, ‘এখন আমায় ঠেকায় কে? আমাকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়ে দিল বসুন্ধরা গ্রুপ। মা-বাবাকে নিয়ে ভালো চলতে পারব এখন। পড়াশোনাটাও চালিয়ে নিতে পারব। ’ রাবেয়ার মতোই আত্মবিশ্বাস ভরা মুখ ছিল সব প্রশিক্ষণার্থীর।
ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘এ দেশে বিত্তশালী মানুষের অভাব নেই, কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানবিক বোধ সবার থাকে না। ব্যতিক্রম বসুন্ধরা গ্রুপ। দেশের সবচেয়ে বড় এ ব্যবসায়ী গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান নির্দেশ দিয়েছেন পর্যায়ক্রমে সব জেলা-উপজেলায় অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলতে। প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলতে। নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়ন যাত্রায় সহযোগী হবে। নারীরা এগোলে সমাজ এগিয়ে যাবে। আমি আজ তার নির্দেশে ঘোষণা দিচ্ছি, এ জামালপুর গ্রাম শুধু নয়, সবখানে যারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে পারবে, তাদের কর্মসংস্থানের দিকটিও বিবেচনা করবে বসুন্ধরা গ্রুপ। অর্থের অভাবে যারা আগ্রহ থাকার পরও লেখাপড়া করতে পারছে না, তাদের বৃত্তি দেওয়া হবে। ’
এমন অভিজ্ঞতা এ প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছে ছিল সম্পূর্ণ নতুন। একটি ভাড়া করা ভবনে যখন প্রশিক্ষণ চালু হয়েছিল, তখন থেকেই আগ্রহ ডালপালা মেলতে শুরু করে। দূর-দূরান্ত থেকে দুস্থ নারীরা খবর পেয়ে আসতে শুরু করেন। সেলাই মেশিন বিতরণের দিনও ছিল একই দৃশ্য। গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে এসেছেন রিকশাচালকের স্ত্রী আফছানা বেগম। বললেন, ‘আমি প্রশিক্ষণ নেবার সুযোগ পাইনি। কিন্তু মন থেকে দোয়া করি বসুন্ধরার বড় স্যারগো জন্য। আল্লাহ যেন তাদের নেক হায়াত দান করেন। ’
উপজেলা চেয়ারম্যান শাহরিয়া খান বিপ্লব বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপ মানবিক কর্মকাণ্ডের অন্যান্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সাদুল্যাপুরের এ প্রত্যন্ত গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার উদ্যোগের কথা এখন মানুষের মুখে মুখে। এমন একটি মহতী কাজ নিয়ে ইমদাদুল হক মিলনের উপস্থিতিই প্রমাণ করে বসুন্ধরা মানবকল্যাণে কতটা নিবেদিত।
ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদ হাসান মণ্ডল বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানসহ সংশ্লিষ্ট সবার দীর্ঘায়ু কামনা করে বলেন, এ প্রশিক্ষণকেন্দ্রটি ধারাবাহিকভাবে চললে অসচ্ছল নারীরা অনেক উপকৃত হবেন। শুভসংঘের শুভ কাজগুলো অব্যাহত থাকুক।
প্রেসক্লাবের সভাপতি তাজুল ইসলাম রেজা বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিটি কর্মেই রয়েছে মাটি ও মানুষের জন্য দায়বদ্ধতা। করোনাকালে যেভাবে হাজার হাজার মানুষকে এক মাসের খাবার দিয়েছে, তা প্রশংসাতীত। দুস্থদের ঘর নির্মাণ, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানসহ নারীদের স্বাবলম্বী করার মতো সেবামূলক কাজ আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। শুভ কাজে তাদের এই আত্মনিবেদনকে স্বাগত জানাই। ’
স্থানীয় গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম জানান, যাদের সেলাই মেশিন দেওয়া হলো, তাদের অনেকেই তার স্কুলের ছাত্রী। এই প্রশিক্ষণ মেয়েদের সাহসী হতে সাহায্য করবে।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও কালের কণ্ঠ’র প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলনকে কাছে পেয়ে প্রশিক্ষণার্থী অসচ্ছল কিশোরী, তরুণী ও গৃহবধূরা খুলে বসেন তাদের সমস্যা-সংকটের ঝাঁপি। কান্নাভেজা গলায় রিতু আক্তার জানান, বাড়িতে অসুস্থ কর্মহীন বাবা। মা মরিয়ম বেগম মানুষের বাসায় কাজ করে পাঁচ ভাই-বোনসহ ১০ জনের সংসার চালান। চলতি বছরে এইচএসসি উত্তীর্ণ রিতু অর্থের অভাবে অনার্সে ভর্তি হতে পারছেন না। তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এ সেলাই মেশিন তাকে স্বাবলম্বী হওয়ার সাহস জোগাচ্ছে। তিনি সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি করতে চান। তার পরও অনিশ্চয়তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
তার কথা শুনে ইমদাদুল হক মিলন বলেন, রিতুর সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জনে বসুন্ধরা গ্রুপ ও কালের কণ্ঠ শুভসংঘ পাশে দাঁড়াবে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অসচ্ছল ছাত্রীদের বৃত্তির ব্যবস্থা করা হবে।
সেলাই মেশিন বিতরণ শেষে শুভসংঘ পাঠাগারের উদ্বোধন করা হয়। পাঠাগারে চার শতাধিক বই স্থান পেয়েছে এবং এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পাঠাগারে আসতে শুরু করেছে। সেলাই মেশিন বিতরণ শেষে বই পড়তে আসা ৩০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন ইমদাদুল হক মিলন।
তিনি বলেন, এ এলাকার শিক্ষার্থীরা কোনো সমস্যায় পড়লে, তাদের শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হলে পাশে থাকবে বসুন্ধরা গ্রুপ। সব শেষে গাইবান্ধার আলোড়ন সৃষ্টিকারী কৃষি উদ্যোক্তা কিবরিয়া মণ্ডলের বাগান ঘুরে দেখেন তিনি।
পুরো আয়োজন সমন্বয় করেন হুমায়ুন আহমেদ বিপ্লব, আতিকুর রহমান, তনু রায়, মাহাবুব রহমান রনি, দেবী সাহা, জান্নাতুল মাহা মীম, আহসানিয়া তাসলিম স্নিগ্ধা, আহসান আজীম নাইম, সৈকত প্রধান, জয়কুমার দাশ, মিথুন কুমার সরকার, আশিকুর রহমান, সাইদুর রহমান প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৬ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০২৩