ঢাকা: রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক হৃদরোগীর কাছে ‘অনৈতিক রিং বাণিজ্য ও ভুল চিকিৎসায়’ তার মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। দায়িত্বে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়া অপচিকিৎসার দায় উঠেছে হাসপাতালের দায়িত্বরত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. গোলাম আজম, ডা. শেখর কুমার মণ্ডল ও ডা. রাশেদুল হাসান কনকের বিরুদ্ধে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও দাবি করেছে ‘ভুক্তভোগীর’ পরিবার।
মঙ্গলবার (৬ জুন) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন এসব অভিযোগ করে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মৃত্যু হয় জাকির হোসেন খান নামে এক ব্যক্তির পরিবার। এ সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জাকিরের স্ত্রী নূরুন নাহার। উপস্থিত ছিলেন জাকিরের ভাই গোলজার হোসেন খান, শ্যালক মানিউল্লাহ মানি, বোন-জামাই সাইফুল ইসলাম, বন্ধু মো. টিটুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
লিখিত বক্তব্যে নূরুন নাহার বলেন, আমার স্বামী গত ১২ মার্চ আনুমানিক সকাল ৮টার দিকে শারীরিক অসুস্থতা বোধ করেন। পরে আমি তাকে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে যাই। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাশেদুল হাসান কনক আমার স্বামীকে ভর্তি হতে বলেন। সে অনুযায়ী হাসপাতালের ১২২৭/এ কেবিনে ভর্তি হলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোগীর চিকিৎসাপত্রে শুধুমাত্র তিনটি গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দিয়ে ছাড়পত্র দেন।
পরবর্তীতে একই দিন সন্ধ্যায় বিআরবি হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোলজির চিকিৎসক মো. মাহবুবুল আলম প্রিন্সকে দেখালে উনি আমার স্বামীর ডায়াবেটিস ও বুকের ব্যথার বিষয়টি জেনে একজন হার্টের ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দেন। পরে বিআরবি হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট শেখর কুমার মণ্ডলকে দেখালে তিনি রোগীর ইসিজি ও ইকো করান। এরপর তিনি ‘রোগী দেড় ঘণ্টার বেশি বাঁচবেন না’ বলে আমাকে জানান। তিনি এও বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব রোগীর এনজিওগ্রাম করে হার্টে রিং পরাতে হবে। ’
এ কথা শোনার পর আমার স্বামী ঘাবড়ে যান। পরে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে শেখর কুমার তাৎক্ষণিক বলে ওঠেন, ‘আপনার স্বামীর হার্টের কার্যকারিতা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। রোগীর বর্তমান যে অবস্থা, এত সময় আপনারা পাবেন না। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ’ পরে রোগীকে নিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতালে যেতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ল্যাবএইডের ক্যাথল্যাব রেডি নাই। একমাত্র গ্রিন লাইফ হাসপাতালেই ক্যাথল্যাব রেডি আছে। ’ এ সময় তিনি নিজেই রিং পরাবেন বলে জানান। আমাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যান।
নূরুন নাহার বলেন, আমরা গ্রিন লাইফ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে বসে আমার দেবরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ডা. শেখর কুমার মণ্ডল আমাকে টেলিফোনে ধমকের সুরে বলেন, ‘আপনি এখনো রোগী নিয়ে বসে আছেন? দ্রুত চলে আসেন। আমি ও অধ্যাপক ডা: গোলাম আজম ওটি রেডি করে বসে আছি। ’
ততক্ষণে আমার দেবরও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন গ্রিন লাইফ হাসপাতালে পৌঁছে রোগীর সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান। কিন্তু আমাদের দেবরকে চিকিৎসকরা কোনো তথ্য দিয়ে সহায়তা করেননি। রোগীকে কোন প্রকার রিং পরানো হবে, কি ব্র্যান্ড, কত টাকা লাগবে এসব কোনো ধরনের তথ্য না দিয়ে আমাদের পাশের একটা রুমে অপেক্ষা করতে বলেন।
আমার স্বামী মরহুম জাকির হোসেন খান বিগত প্রায় ৮ বছর ধরে ডায়াবেটিসের রোগী। নিয়মিত ইনসুলিন নিতেন। এ বিষয়ে আমরা ডা. শেখরকে বিআরবি হাসপাতালে তার চেম্বারে বসেই জানাই। তারপরও তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর অপারেশনের আগে ও পরে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি। গত ১৩ মার্চ বিকেল আনুমানিক পৌনে চারটার দিকে শেখ মণ্ডল আমাকে ফোন করে বলেন, ‘রোগীর অবস্থা ভালো না, তার কিটোন বডি পজিটিভ। ’
আমরা রোগীকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতে চাইলে ডা. শেখর কুমার মণ্ডল অসম্মতি জানান। তিনি বলেন, ‘আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন। ’ এর ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর আইসিইউ ইনচার্জ ডাক্তার মো. আসাদুজ্জামান আমাদের ডেকে বলেন, ‘রোগীর ফুসফুসে নিউমোনিয়াসহ মাল্টিপল অর্গান ফেল করেছে। ’ এরপর রোগীকে আইসিইউ বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু তার অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যেতে থাকে।
পরবর্তীতে সেদিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে জাকিরকে আইসিইউ থেকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার আগেই হার্ট ফেইলর হওয়ায় ফুসফুসে রক্ত ও পানি জমে যায়। ক্রমান্বয়ে রোগীর অবস্থা আরও অবনতি হতে থাকে। এক পর্যায়ে রোগীর মৃত্যু হয়।
জাকিরের স্ত্রী আরও বলেন, ডাক্তার শেখর কুমার মণ্ডল আমাদের কিছু না বলে ওই রাতেই গোপনে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। গত ১৬ মার্চ বেলা আনুমানিক ১১টায় আমরা জাকিরের মরদেহ নিতে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনার বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাই। আমাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একাধিকবার সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে আমাদের সামনে মোবাইলে কথা বলে। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও আলাপ-আলোচনা করে। সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে তারা নিশ্চিত হয় যে, আমাদের মৌখিক অভিযোগের যথেষ্ট সত্যতা রয়েছে। ফলে তারা এই দুর্ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে হাসপাতালের বিল ছয় লাখ চব্বিশ হাজার চারশত ছেচল্লিশ টাকা দাবি না করে মরদেহ নিয়ে যেতে বলেন। তারা হাসপাতালের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে বিষয়টি বাইরে আলাপ-আলোচনা না করতেও আমাদের অনুরোধ করেন।
কিন্তু তারা যে বিচারের আশ্বাস দিয়েছিল, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়নি। উল্লিখিত বিষয়ের আলোকে আমরা রাজধানীর কলাবাগান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। ডিজি হেলথও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে বিচার চেয়ে অভিযোগ জমা দেই। কিন্তু আমি কারও কাছ থেকেই এখন পর্যন্ত ন্যায় বিচার পাইনি।
আমার স্বামী আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আমার স্বামী ছিলেন আমার আশ্রয়, আমার মেয়েদের আশ্রয়। আমরা এখন অভিভাবক হারা, আমার সন্তানেরা এখন এতিম। এরজন্য দায়ী কে? প্রয়োজনীয় চিকিৎসার যন্ত্রপাতি না থাকাসহ সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও অবহেলায় অপচিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন আমার স্বামী। আমি ও আমার পরিবার চাই সংশ্লিষ্ট তিন চিকিৎসকের চিকিৎসা সনদ বাতিল করা হোক, বলেন নূরুন নাহার।
এ বিষয় সম্পর্কে জানতে গ্রিন লাইফ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে সহায়তা করেননি। তা ছাড়া যে তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদেরও পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৭ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০২৩
ইএসএস/এমজে