ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

গরমে অসুস্থ হওয়া সামাদই বাংলা টিভির কেলেঙ্কারির হোতা!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫২ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২৩
গরমে অসুস্থ হওয়া সামাদই বাংলা টিভির কেলেঙ্কারির হোতা!

ঢাকা: ২০১৭ সালে সম্প্রচারে আসার আগে থেকেই নানা অভিযোগ ছিল দেশের বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল ‘বাংলা টিভি’ নিয়ে। দিন যত গড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কেলেঙ্কারি বেড়েছে।

কোটি টাকার বিনিময়ে হোল্ডারদের বাইরের লোককে চেয়ারম্যান করা; কর্মীদের বেতন-ভাতা না দেওয়া অংশীদারত্ব নিয়ে ইস্যু তৈরিসহ নানা কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছে বাংলা টিভি। আর এসবের পেছনে রয়েছেন মাত্র একজন ব্যক্তি। তিনি টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যুক্তরাজ্য প্রবাসী সৈয়দ সামাদুল হক। নিজেকে তিনি চ্যানেলটির মালিক বলেও দাবি করেন।

চ্যানেলের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অভিযোগ ওঠার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্প্রতি তাকে তলব করে। কিন্তু সামাদ ‘গরমে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার’ দোহাই দিয়ে কমিশনে যাননি। চ্যানেলের বাইরেও তাকে নিয়ে আছে আরও অভিযোগ। লোকমুখে শোনা যায়, সামাদ তার স্ত্রী রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ও কর্মীদের সঙ্গেও ছলচাতুরী করেন। এটি নাকি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য!

অতিসম্প্রতি দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে বাংলা টিভির মালিকসহ শেয়ার হোল্ডারদের নাম প্রকাশিত হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, চ্যানেলটির বর্তমান চেয়ারম্যান আখতার ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী কে এম আখতারুজ্জামান, তার ছেলে কে এম রিফাতুজ্জামান (পরিচালক) ও বিটিভির সাবেক সংবাদ পাঠক মনিরুল ইসলাম (ভাইস চেয়ারম্যান)। তাদের কাছে ২০ কোটি টাকার বিনিময়ে বাংলা টিভির শেয়ার বিক্রি করেন সামাদ।

কিন্তু ২০১৭ সালে সম্প্রচারে আসার আগে টেলিভিশনটির চেয়ারম্যান ছিলেন সিলেটের ব্যবসায়ী রাগীব আলী। কোটি টাকার বিনিময়ে তাকে বাংলা টিভির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। টেলিভিশন সম্প্রচারে আসে সিদ্ধেশ্বরীতে রাগীবের মালিকানাধীন একটি ভবন থেকে।

অবাক করার মতো বিষয় হলো- সামাদুল হক প্রবাসী কোটায় টিভি চ্যানেলটির অনুমোদন পেলেও এর মালিকানায় নেই কোনো প্রবাসী ব্যক্তি। তা ছাড়া যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সুপারিশে তিনি লাইসেন্স পেলেও সেখানকার সংশ্লিষ্ট কাউকে তিনি টিভির মালিকানায় রাখেননি।

জানা গেছে, ব্রিটেন প্রবাসী প্রয়াত সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর সুপারিশে সামাদ বাংলা টিভির লাইসেন্স পান। অথচ তিনি গাফফারের কোনো সন্তানকে টেলিভিশনের মালিকানায় রাখেননি। এমনকি অর্থ দিয়ে পরিচালক পদেও নয়।

এ বিষয়ে কথা হলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফ বলেন, যুক্তরাজ্যে তার মালিকানায় প্রকাশিত হয় জনমত পত্রিকা। সামাদুল হক এক সময় সেখানে চাকরি করতেন। তারপরও বাংলা টিভির সঙ্গে আমার ব্যবসায়িক অংশীদারত্ব নেই। যুক্তরাজ্যের কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকেই শেয়ার দেননি সামাদ।

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের আরও নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সামাদ অত্যন্ত চতুর। আওয়ামী লীগের কোনো নেতার কাছে চ্যানেলের শেয়ার না দেওয়ার পেছনে তার ব্যাপক পরিকল্পনা আছে। বিএনপি যদি ক্ষমতায় যায়, তার যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে কারণে তিনি আওয়ামী লীগের কারও কাছে শেয়ার বিক্রি করেননি। বরং বিএনপিপন্থী চিহ্নিত ব্যবসায়ীদের কাছে শেয়ার মালিকানা দিয়েছেন।

২০০৫ সালে বিএনপি সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মোজাম্মেল হককে নিয়ে তিনি চ্যানেল এস নামে একটি ডাউনলিংক চ্যানেল চালু করেছিলেন সামাদুল। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ওই চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায়। দেশে সম্প্রচারে থাকা মাই টিভির স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন সাথীর প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সামাদুল। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি লন্ডনে চলে আসেন।

সামাদুল তার স্ত্রীকেও বিশ্বাস করেন না। তাকে তিনি বাংলা টিভির মালিকানায় রাখেননি। বরং তার জায়গায় নিজের ভাগ্নেকে মালিকানা দিয়েছেন। সামাদুলের স্ত্রী ডক্টরেট ডিগ্রিধারী। কিন্তু তাকে মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতনে তিনি চ্যানেলটিতে কাজ করান। ভাগ্নেকে দেন মাসিক এক লাখ টাকা।

তিনি নিজের চ্যানেলের কর্মীদেরও বেতন-ভাতা ঠিকমতো দেন না। বরং অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ বাণিজ্য করেন। মফস্বল প্রতিনিধিদেরও তিনি বেতন দেন না। কিন্তু তাদের এলাকায় গিয়ে সামাদ তাদের অর্থেই ঘুরে বেড়ান, খাওয়া দাওয়া করেন। এ ছাড়া অসংখ্য অভিযোগ আছে প্রবাসী সামাদের বিরুদ্ধে। যার মধ্যে অন্যতম বাংলা টিভির নামে অর্থ পাচার ও আত্মসাৎ। তা ছাড়া কর ফাঁকির অভিযোগ‌ও রয়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, বাংলা টিভির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে মোটা অংকের কর ফাঁকি ও মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ চলছে।

অভিযোগের পর বাংলা টিভির এমডি সামাদুলসহ বাকিদের তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন। গত রোববার দুদকের পক্ষে এ সংক্রান্ত নোটিশ জারি করা হয়। দুদকের উপপরিচালক সেলিনা আখতার মনি স্বাক্ষরিত নোটিশে উল্লেখ করা হয়, বাংলা টিভির শেয়ার হস্তান্তরের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সামাদুল হক, চেয়ারম্যান কে এম আখতারুজ্জামান, পরিচালক মীর নুর উস শামস শান্তনু ও কে এম রিফাতুজ্জামানের বক্তব্য শ্রবণ ও গ্রহণ করা প্রয়োজন। এজন্য তাদের ৭ জুন, দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়।

কিন্তু গত বুধবার (৭ জুন) তাদের কেউই দুদকের তলবে হাজির না হয়ে সময়ের আবেদন করেন। গরমে অসুস্থতার জন্য দুদকের কাছে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য না দিয়ে সময়ের আবেদন করেন সামাদুল হক। তার পথ ধরেই পরিচালক রিফাতুজ্জামান, শান্তনু ও মনিরুল ইসলাম‌ও সময়ের আবেদন করেন। তাদের একজনের স্ত্রী, একজনের মা ও একজনের বাবা অসুস্থ- যে কারণে তারা দুদকে যেতে পারবেন না বলে জানান।

দুদকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলা টিভির পরিচালনা পর্ষদে যারা আছেন, তারা একজোট এবং সিন্ডিকেট করে সময়ের আবেদন করেছেন তা স্পষ্ট। মূলত, বাংলা টিভিকে তারা নিজেদের অবৈধ সম্পদ রক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে সব কিছু বেরিয়ে আসবে ভেবেই তারা সময় নিয়ে টালবাহানা করছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০২৩
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।