মৌলভীবাজার: ১৪ জুন বুধবার মাগুরছড়া ট্রাজেডির ২৬তম বার্ষিকী। দিনটি এলেই মৌলভীবাজার জেলাবাসীকে মনে করিয়ে দেয় সেই ভয়াল স্মৃতির কথা।
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাত ১টা ৪৫ মিনিটে মাগুরছড়া গ্যাসকূপে বিস্ফোরণে প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠেছিল গোটা কমলগঞ্জ। আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে উঠেছিল আকাশ।
এ সময় শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ১৫ কিলোমিটার (৩৩ হাজার কেভি) উচ্চতাপ বৈদ্যুতিক লাইন পুড়ে নষ্ট হয়। কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০টি চাবাগানে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের বৃক্ষ সম্পদ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া ২৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার।
প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন ঘর-বাড়ি ফেলে প্রাণভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। আগুনের শিখায় গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, জীববৈচিত্র্য, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ী চা বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট- চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম এ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘন গভীর বন ও বিপুল সংখ্যক প্রাণীবৈচিত্র্য। ক্ষতির মুখোমুখি হয় রেল ও সড়কপথ, পানজুম, বিদ্যুৎ লাইনসহ এই অঞ্চলের অসংখ্য স্থাপনা।
দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মার্কিন গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি বন বিভাগ। ফিরে আসেনি প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিকতা। পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি হয়েছে এই গ্যাসক্ষেত্র। শেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
২০১২ সালে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪নং ব্লকের অধীনে নুরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা বাগানের সবুজ বেষ্টনী কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ড্রেন খনন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রিডে স্থানান্তর করছে। মাগুরছড়া ট্রাজেডির ২৬ বছরেও জনসম্মুখে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ হয়নি, আদায় হয়নি ক্ষতিপূরণ।
মাগুরছড়া ট্রাজেডির ২৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে ১৪ জুন বুধবার বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে মাগুরছড়া গ্যাস বিষ্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। এছাড়া বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে দিবসটি পালন করেছে।
পরিবেশ সংরক্ষণবাদীদের তথ্য মতে, ওই অগ্নিকাণ্ডে ৬৩ প্রজাতির পশু-পাখির বিনাশ সাধন হয়। সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেলযোগাযোগ ১৬৩ দিন বন্ধ থাকে। মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। মার্কিন অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোনো ক্ষতিপুরণ পায়নি। গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।
লাউয়াছড়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. সহিদুল ইসলাম জানান, বনের ক্ষতি নিরূপন করে দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোনো সময়ে পুষিয়ে নেওয়া যায় না। আমার জানা মতো মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়নি। বন ও পরিবেশের এই ক্ষতিপূরণ আদায় হওয়া আমাদেরও দাবি।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম এ ব্যাপারে বলেন, আমি এ জেলায় নতুন যোগদান করেছি। মাগুরছড়ায় অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে আমার কাছে ক্ষতিপূরণের কোনো আবেদন জমা থাকলে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করব।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫১ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২৩
বিবিবি