ঢাকা: লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন। বাসাবাড়ি তো বটেই, দোকানপাট ও শিল্পকারখানাও বর্তমানে বিদ্যুতের ঘাটতিতে ভুগছে।
বিকল্প হিসেবে সচ্ছলদের মধ্যে অনেকেই এখন বাসাবাড়ি, অফিসে ব্যবহারের জন্য কিনছেন আইপিএস। হঠাৎ আইপিএসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে দেখা দিয়েছে সরবরাহ ঘাটতি।
এদিকে ডলার সংকটে এলসি বন্ধ ও ডলারের বাড়তি দাম থাকায় আইপিএসের যন্ত্রাংশ এখন আমদানি হচ্ছে না। এতে করে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বাজারে কিনতে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে না আইপিএস। যদিও পাওয়া যাচ্ছে, গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
তবে আমদানি করা আইপিএস বাজারে কম পাওয়া গেলেও দেশি কোম্পানিগুলোর আইপিএস বাজারে পর্যাপ্ত পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে দেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে রহিম আফরোজের আইপিএস পাওয়া যাচ্ছে। একইসঙ্গে আমদানিকৃত আইপিএসের তুলনায় দামও কম। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
আইপিএস প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারকেরা বলছেন, গত কয়েক বছরে বিদ্যুতের ঘাটতি না হওয়ার ফলে আইপিএসের ব্যবসা একেবারে পড়তির দিকে ছিল। গত এক মাস আগে চাহিদা তেমন না থাকলেও লোডশেডিংয়ে গত ২০ দিন ধরে বিক্রি বেড়েছে। এতে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে ডলার সংকটে আমদানি চাপে থাকায় ঘাটতি প্রকট হয়েছে। এ খাতের দেশীয় কোম্পানিগুলো চেষ্টা করছে দ্রুত আইপিএস উৎপাদন করে বাজারে ছাড়তে। তবে একটু সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এসব কোম্পানি। কারণ, লোডশেডিং কমে গেলে এই পণ্যের চাহিদা আবার রাতারাতি কমে যেতে পারে বলেও মনে করছে তারা।
রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকায় আইপিএস বিক্রি অনেকটাই কমে গিয়েছিল। যারা একসময় আইপিএস ব্যবহার করতেন, তারাও এক পর্যায়ে পুরনো আইপিএস বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন লোডশেডিং থাকায় আইপিএস কিনতে ইলেকট্রিক দোকানে ভিড় করছেন ক্রেতারা।
বিক্রেতারা বলেন, দেশে আইপিএস উৎপাদন করে মাত্র কয়েকটি কোম্পানি। তারাও আইপিএস এর যন্ত্রাংশ বাইরে থেকে আমদানি করে এনে দেশে তৈরি করেন। কিন্তু ডলার সংকটে এলসি বন্ধ ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি থাকায় এসব যন্ত্রাংশ এখন আমদানি হচ্ছে না। ফলে আইপিএস উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।
জানা গেছে, বর্তমানে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আইপিএস। এর মধ্যে অন্যতম লুমিনাস ও মাইক্রোটেক। এরপরই রয়েছে হ্যামকো, লিভগার্ড, এমাজি, ইউটিএল ডামা প্লাস, এক্সাইডের মতো কিছু প্রতিষ্ঠানের পণ্য।
বাজারে দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের আইপিএসও বেশ ভালো বিক্রি হতে দেখা গেছে। তারমধ্যে রয়েছে রহিম আফরোজ, সাইফ পাওয়ারটেক, মাইক্রো পিএসের আইপিএস। তবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের আইপিএসের দাম বিদেশি ব্র্যান্ডের তুলনায় অনেক কম থাকায় এবং আমদানি কম হওয়ায় বাজারে দেশি ব্র্যান্ডের আইপিএসই বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান বিক্রেতারা।
রহিম আফরোজের মার্কেটিং অফিসার (আইপিএস) মাঝারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, লোডশেডিংয়ের জন্য আইপিএসের এখন প্রচুর চাহিদা বেড়েছে। লোডশেডিং চলমান থাকলে কিছু দিন পর আইপিএস বিক্রি আরও বাড়তে পারে। আমাদের ছোট-বড় আইপিএস বাজারে পর্যাপ্ত রয়েছে। বিক্রি আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু আমরা একমাত্র প্রতিষ্ঠান, পণ্যের চাহিদা বাড়লেও দাম বাড়াইনি। আমাদের প্রতিষ্ঠান গত মার্চ মাসে সর্বশেষ আইপিএস এর দাম বাড়ায়। তা কোম্পানির পলিসি অনুযায়ী। এর পড় গত মে মাসের শেষে দিকে আইপিএসের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও আমরা আগের দামেই পণ্য বিক্রি করছি।
তিনি বলেন, ৬০০ভিএ, ৭০০ভিএ ও ১০০০ভিএ এই আইপিএসগুলো চাহিদা অনেক বেশি। ফলে হঠাৎ যদি কেউ ৩০/৪০ ইউনিট আইপিএস একসঙ্গে নিতে চাইলে আমাদের কাছে আগে থেকেই অর্ডার দিতে হবে। কেননা শোরুমে তো এত ইউনিট আইপিএস থাকবে না। এ জন্য একটু সময় দিলে আমরা পণ্য দিতে পারব। তবে বাজারে এখন আমাদের আইপিএসই বিশ্ব মানের। পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে।
স্টেডিয়াম মার্কেটের মাইক্রো পিএস ইলেকট্রনিকের ডিলার বিএস আক্তার ফারুক ফখরুল বাংলানিউজকে বলেন, অতিরিক্ত লোডশেডিং ও অসহনীয় গরমের জন্য হঠাৎ গত ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে আইপিএসের চাহিদা বেড়ে গেছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় আইপিএস বিক্রি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। এতে করে আইপিএস এর সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে দামও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের জন্য আইপিএস ও ব্যাটারি উৎপাদন করতে পারছে না। একইসঙ্গে ডলার সংকট, উচ্চমূল্য, এলসি বন্ধ থাকায় গত ৬ মাসে তেমন কোন আইপিএস আমদানি হয়নি। ফলে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে কোথাও আমদানিকৃত আইপিএস পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু দেশি কোম্পানির কিছু আইপিএস বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, মাইক্রো পিএসের একটি ৬০০ভিএ আইপিএস সেটে তিনটি লাইট ও ফ্যান চলে। যেটির দাম আগে ৩০ হাজার থেকে ৩২ হাজার টাকা ছিল। এখন তা ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমরা মেশিনে এক বছরের গ্যারান্টি ও ব্যাটারিতে দেড় বছরের ওয়ারেন্টি দিচ্ছি। আইপিএস ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে বাসাবাড়ির জন্য ৬০০ ভিএ থেকে ১২০০ ভিএ এই ধরনের আইপিএসের চাহিদা বেশি।
ইলেকট্রিক পণ্যের সবচেয়ে বড় মার্কেট নবাবপুর রোড সেখানে মোহন ইলেকট্রিক মার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ী মুজিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমি কয়েকটি কোম্পানির পরিবেশক হিসেবে কাজ করছি অনেক দিন হলো। কিন্তু এমন পরিস্থিতি কখনো হতে দেখিনি। দেশে আবার কখনো আইপিএসের ব্যবসা চাঙা হতে পারে, এটা আমাদের ধারণাতেই ছিল না। বিদ্যুতের বড় সংকট ছাড়া আইপিএস এখন কেউ কেনেন না বললেই চলে।
তিনি বলেন, হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমরা এখন চাহিদামতো আইপিএস দিতে পারছি না। ১০টি আইপিএসের জন্য বললে দিচ্ছে একটি বা দুটি। ফলে ক্রেতাদের দেওয়া কথা আমরা রাখতে পারছি না। আইপিএসের সরবরাহ এবার বেশ কম। ফলে অনেকে আইপিএস কিনতে এসে চার্জার ফ্যান কিনছেন। আইপিএসের জন্য বলে যাচ্ছেন। আমরা অর্ডার পেলে কোম্পানি বা আমদানিকারকের কাছ থেকে সংগ্রহ করে ক্রেতাদের সরবরাহ করছি।
রাজধানীর ইসলামপুরের পাটুয়াটুলীর মুন মার্কেটের আর কে ইলেকট্রনিকসের মালিক মো. নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের নিজস্ব কারখানায় আইপিএস তৈরি করি। আর ব্যাটারি অন্য জায়গা থেকে এনে দিই। লোডশেডিং শুরু হওয়ার পর থেকে আইপিএসের চাহিদা বেড়ে গেছে। ঢাকার বাইরে থেকে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা আইপিএস নিতে দোকানে আসছেন। স্বাভাবিক সময়ে দিনে এক-দুটি আইপিএস বিক্রি হতো। এখন চাহিদা বাড়ায় দিনে চার-পাঁচটি আইপিএস বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, দুই লাইট ও দুই ফ্যানের একটি শুধু আইপিএস মেশিন ৭ হাজার টাকা, ৪ লাইট ও ৪ ফ্যানের একটি আইপিএস ৯ হাজার টাকা মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে এবং ১০ লাইট ও ৮ ফ্যানের আইপিএস ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এর সঙ্গে ব্যাটারির দাম ধরে নিলে মূল দামটা আসবে। যেহেতু আমরা শুধু আইপিএস তৈরি করি, তাই সেটার দামই বললাম। বাজারে সাধারণত বাসাবাড়িতে ব্যবহারের জন্য আইপিএসগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে আইপিএসের চাহিদা বেড়েছে। হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মার্কেটে আইপিএস পাওয়া যাচ্ছিল না। অন্যদিকে বাজারে যেসব ব্র্যান্ডের আইপিএস পাওয়া যেত, তার বেশিরভাগই আমদানি করা হতো। কিন্তু ডলারের দাম এবং আমদানি শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে কোনো এলসি খোলা হচ্ছে না। ফলে বাজারে আইপিএসের আমদানি কম হচ্ছে। এর প্রভাবে বাজারে আইপিএসের দাম বাড়ছে। এই সুযোগে আমাদের কপাল খুলেছে। এখন বাজারে আমাদের দেশে তৈরি আইপিএস পাওয়া যাচ্ছে।
সাইফ পাওয়ারটেকের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা হাসান রেজা বলেন, বাজারে আইপিএসের সংকট হওয়ার অন্যতম কারণ লোডশেডিং। গত কয়েক বছর বিদ্যুতের সমস্যা প্রকট না হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা ভেবে নিয়েছিলেন যে এই পণ্যের চাহিদা থাকবে না। এ জন্য তাদের প্রস্তুতি ছিল না। তাই ক্রেতাদের পণ্য পেতে বিলম্ব হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন আইপিএস কেনার পাশাপাশি ব্যাটারির চাহিদাও বেড়েছে। যাদের বাসায় পুরনো আইপিএস রয়েছে, তারা এখন ব্যাটারি কিনছেন। ফলে বাজারে ব্যাটারির চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোও এখন ব্যাটারি দিতে পারছে না। গত দুই তিন সপ্তাহে আইপিএসের বিক্রি তুলনামূলক ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে।
ইসলামপুরের পাটুয়াটুলীতে আইপিএস কিনতে আসা ক্রেতা সাগর বলেন, লোডশেডিং শুরু হওয়ার পর থেকে বাজারে আইপিএস, চার্জার ফ্যান, চার্জার লাইটের চাহিদা বেড়ে গেছে। এই সুযোগে বিক্রেতারাও এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। যে আইপিএস আগে ২০ হাজার টাকায় কেনা যেত, বাজারে ব্যাটারি সংকটের কথা বলে সেটি বিক্রি করছেন ৩০ হাজার টাকায়।
দেশি প্রতিষ্ঠান রহিম আফরোজের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তাদের তৈরি আইপিএসের দাম ২১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৭ লাখ ২২ হাজার টাকার মধ্যে। গত মার্চ মাস থেকে প্রতিষ্ঠানটি তাদের আইপিএসের দাম বাড়িয়েছে। আইপিএস ২৫০ভিএ ফুল সেট ২১ হাজার ৫০০ টাকা, ৩৫০ভিএ ৩৩ হাজার ৯০০ টাকা, ৫৫০ভিএ ৪১ হাজার টাকা, ৭২৫/১২ভি ৪৯ হাজার ২০০ টাকা, ৯৫০/১২ভি ৫৩ হাজার ৩০০ টাকা, ১১২৫/১২ভি ৫৯ হাজার ৩০০ টাকা, ১৬৫০/২৪ভি ৮৮ হাজার ৯০০ টাকা, ২.২ কেভিএ/২৪ভি এক লাখ ৪ হাজার ৫০০ টাকা, ৩.২ কেভিএ/৩৬ ভি এক লাখ ২৯ হাজার ৯৯০ টাকা এবং ৩.৭ কেভিএ/৪৮ভি এক লাখ ৬১ হাজার ৯০০ টাকায় হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০২৩
জিসিজি/আরএইচ