ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

পদ্মা সেতুর এক বছর: সমৃদ্ধ হচ্ছে বাগেরহাটের অর্থনীতি

এস এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১১ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০২৩
পদ্মা সেতুর এক বছর: সমৃদ্ধ হচ্ছে বাগেরহাটের অর্থনীতি

বাগেরহাট: স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে একক জেলা হিসেবে সব থেকে বেশি লাভবান হয়েছে বাগেরহাট। সেতু উদ্বোধনের পর থেকে জেলার কৃষি, মৎস্য, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে।

সক্ষমতা ব্যস্ততা ও আয় বেড়েছে মোংলা বন্দরের। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মোংলা বন্দরসহ বাগেরহাট জেলার অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে দাবি ব্যবসায়ীদের।

মোংলা বন্দর সূত্রে জানা যায়, মাওয়া ঘাটে ফেরির ভোগান্তির জন্য এই বন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতেন না ব্যবসায়ীরা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে ব্যবসায়ীরা মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু করেছেন। এক বছরে ৫টি জাহাজে বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে এই বন্দর দিয়ে। দেশি-বিদেশি জাহাজের আগমন নির্গমন বেড়েছে। কন্টেইনারবাহী জাহাজের আগমন বেড়েছে ১৫ শতাংশ।  

২০২১-২২ অর্থ বছরে যেখানে কন্টেইনারবাহী জাহাজ এসেছিল ৪৫টি, চলতি অর্থবছরে এসেছে ৫২টি। মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ৬ হাজার ২৫৬ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী।  

তিনি বলেন, ঢাকা থেকে সড়ক পথে মোংলা বন্দরের দূরত্ব মাত্র ১৭০ কিলোমিটার। অপরদিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার। সেতু চালু হওয়ার ফলে সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন হওয়ায় সময় ও ব্যয় দুটোই কমেছে ব্যবসায়ীদের। ফলে ব্যবসায়ীরা এই বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এছাড়া মোংলা বন্দরে জাহাজ হ্যান্ডলিং দ্রুত ও নিরাপদে হয়।  

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বন্দর এলাকায় ১১টি এলপিজি কারখানা, ৫টি সিমেন্ট কারখানা ও বিভিন্ন ধরনের ১০টি শিল্প কারখানা রয়েছে। বন্দরের ২৫৮ একর জমিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল বেপজা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের আগ্রহ জানিয়েছে।

তবে বন্দর এলাকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ ও ভাঙ্গা থেকে মোংলা পর্যন্ত দুই লেনের সড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করতে না পারলে পদ্মা সেতুর শতভাগ সুফল বাগেরহাটবাসী পাবে না। সেতুর সুফল পুরোপুরি পেতে এবং নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যস সরবরাহ ও ছয় লেনের প্রশস্ত সড়ক নির্মাণের দাবি ব্যবসায়ীদের। বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের সভাপতি লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, স্বল্প ব্যয়ে উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ খুবই প্রয়োজন। মোংলা ও বাগেরহাটের গ্যাস না থাকায় ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে যায়।  সড়কগুলোও প্রশস্ত করা দরকার বলে জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।

এদিকে সেতু চালুর পরে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাট গম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবনে দর্শনার্থী বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন বলেন, গেল এক বছরে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৮ জন দেশি ও ১ হাজার ৬৭৫ জন বিদেশি দর্শনার্থীর আগমন ঘটেছে। যার মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে এক কোটি ৮৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। যা গেল বছরের তুলনায় দ্বিগুণ।  

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাস্টোডিয়ান মোহাম্মাদ যায়েদ বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ষাটগম্বুজ দেখতে চার লাখ ৯৬ হাজার ৮ জন দেশি ও ১ হাজার ৪৮২ জন বিদেশি দর্শনার্থী এসেছেন। যার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৭ লাখ টাকা। গেল বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থ বছরে দেশি দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ১৫ হাজার এবং বিদেশি দর্শনার্থী ছিল ২৮৯ জন।  

পদ্মা সেতু চালুর পর কৃষি নির্ভর বাগেরহাটে সবজির উৎপাদন ১৫-২৫ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের উপ-পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, জেলার ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়। ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরা সবজি চাষে আধুনিক প্রযুক্তি ও সারের ব্যবহার শুরু করেছেন। এর ফলে উৎপাদন বেড়েছে। গেল বছর যেখানে হেক্টর প্রতি সবজির উৎপাদন ছিল ২০ মেট্রিক টন, সেখানে বর্তমানে ২৫ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হচ্ছে।  

সদর উপজেলার খানপুর এলাকার সবজি চাষি আব্দুল হাকিম শেখ বলেন, বছরজুড়ে সবজি চাষ করেই আমাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। আগে পদ্মা নদীর পাড়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার কারণে আমরা ঢাকার বাজারে সময়মতো গিয়ে কৃষিপণ্য পৌঁছাতে পারতাম না। পথেই অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যেত। তাই স্থানীয় বাজারে বা ফড়িয়াদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে হত। এখন সেতু দিয়ে সহজেই আমরা গাড়ি ভাড়া করে সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে পারছি। সেতু চালুর এক বছর আগের তুলনায় এ বছর দ্বিগুণ লাভ হয়েছে।

একই এলাকার গাউস মল্লিক ১০ বিঘা জমিতে বর্ষাকালীন বিভিন্ন সবজি চাষ করেন দুই দশক ধরে। তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে উৎপাদিত সবজি কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হতাম আমরা। এখন পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে গেছে। ট্রাক ভাড়া করে সবজি ঢাকা নিয়ে যাই। আবার রাতের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসি।

বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াপাড়া, ডেমা, কাশিমপুর এলাকার একাধিক মৎস্য চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিংড়ি ও কার্প জাতীয় মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল, টেংরা, পারসে, বেলে,  তেলাপিয়া, পাতাড়ি) সহ উৎপাদিত মাছের বড় অংশের বাজার ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় এক বছর আগেও স্থানীয় ফড়িয়া ও আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে খুব একটা লাভবান হতে পারতেন না প্রান্তিক চাষিরা। তবে পদ্মা সেতু দিয়ে বাগেরহাট থেকে ঢাকায় যেতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা। ফলে ঢাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চাষিরা সরাসরি ঘের থেকেই মাছ গাড়িতে করে ঢাকায় পাঠাতে পারছেন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে মৎস্য খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। মাছের চাহিদা ও উৎপাদন দুটোই বেড়েছে বাগেরহাটে। সাদা মাছের দাম কেজি প্রতি বেড়েছে  ৫০ থেকে ১০০ টাকা। অন্যদিকে রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুচিয়ার দামও বেড়েছে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। গেল বছর জেলায় ৯৯ হাজার মেট্রিক টন সাদা মাছ উৎপাদন হলেও, এ বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লক্ষ ১০ হাজার মেট্রিক টন।

এদিকে পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে বাগেরহাটের সঙ্গে সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন হয়েছে। বেড়েছে যাত্রীবাহী বাস ও পণ্য পরিবহনকারী যানবাহন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অনেকের। রাজধানী থেকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে দিনে দিনে বাড়ি ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে জেলাবাসীর।

বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তালুকদার আব্দুল বাকি বলেন, স্বপ্নের সেতু চালুর মধ্য দিয়ে পরিবহন সেক্টর অনেকটা এগিয়ে গেছে, যাত্রীদেরও ভোগান্তি কমেছে। বেড়েছে বিলাসবহুলসহ দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা। বাগেরহাট থেকেই সরাসরি পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এক সময়ের চিরচেনা মাওয়া ঘাটের ভোগান্তি এখন আর পোহাতে হয় না জেলাবাসীকে।

পদ্মা সেতু চালুর ফলে এই অঞ্চলে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নিয়েছে বড় বড় শিল্প গ্রুপ। মোল্লাহাট থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে নতুন নতুন জমি ক্রয় করেছেন শিল্প গ্রুপের মালিকরা। এছাড়া কাটাখালী-মোংলা সড়কের দুই পাশে বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় বিক্রয় হয়েছে এক বছরে। যার বেশিরভাগ জমি ক্রয় করেছেন শিল্প গ্রুপের মালিকরা। ভবিষ্যতে এসব স্থানে বড় বড় কল কারখানা স্থাপন হবে বলে ধারণা সাধারণ মানুষের।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে বাগেরহাটের শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সবকিছু কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। এখন যে কেউ ইচ্ছে করলেই ঢাকার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। রাজধানীতে এসে আধুনিক সেবা নিতে পারেন। শুধু রাজধানী নয় অন্যান্য জেলার সঙ্গেও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে বাগেরহাটবাসীর। এসব কারণে বাগেরহাটে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাগেরহাটের অর্থনীতি আরও বড় হবে দাবি করেন জেলা প্রশাসনের এই শীর্ষ কর্মকর্তা।  

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০২৩

আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।