ঢাকা, শনিবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

চাঁপাইনবাবগঞ্জে শত কোটি টাকা আত্মসাৎ, চলছে নতুন অ্যাপ

এ কে এস রোকন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০২৩
চাঁপাইনবাবগঞ্জে শত কোটি টাকা আত্মসাৎ, চলছে নতুন অ্যাপ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ছাত্র জীবনে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান ডেসটিনিতে কাজ শুরু করেন নুরুন্নবী পলাশ। তিনি ডেসটিনির পিএসডি ছিলেন।

সেই ডেসটিনি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে হরেক রকম প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ার অন তিনি।

ডেসটিনি বন্ধের পর দুই বছর আগে কাজ নুরুন্নবী পলাশ শুরু করেন পিএলসি আলটিমা নামে একটি ক্রিপ্টো ট্রেডিং কোম্পানিতে। পরে দেশের ১১ হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া এমটিএফইতে যোগ দেন তিনি। এমটিএফই এর পর আবার নতুন করে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছেন তিনি। এবার কাজ শুরু করেছেন ‘জিটিসি-এক্স’ নামে আরেকটি বিদেশি অ্যাপে।

সম্প্রতি জিটিসি-এক্স অ্যাপের প্রচারণার অংশ হিসেবে কয়েকজনকে নিয়ে কক্সবাজার ট্যুর দিয়েছেন নুরুন্নবী পলাশ। কক্সবাজার ট্যুরের ছবি দেখে তার নতুন আ্যাপে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন, অ্যাপে ডলার আয়ের ফাঁদসহ হরেক রকম প্রতারণা করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নুরুন্নবী পলাশ। এছাড়াও সুসম্পর্ক গড়ে ভয়াবহ প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রতারণার অর্থে চড়েন দামি গাড়িতে। থাকেন বিলাসী ফ্ল্যাটে। বিনিয়োগ করেছেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। রয়েছে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রা। দুবাইয়ে রেসিডেন্সিও নিয়েছেন।

অভিযুক্ত নুরুন্নবী পলাশের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে। বাবার নাম জুল মো. সর্দার। কৃষিপ্রধান পরিবারে বেড়ে ওঠা নুরুন্নবী পলাশের প্রতারণার জালে আটকে সর্বস্বান্ত অনেক মানুষ। বাদ যায়নি, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, প্রশাসনের কর্মকর্তাও। একটি স্বনামধন্য ব্যাংকের চার কর্মকর্তা প্রায় ৭০ লাখ টাকা হারিয়েছেন। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চাকরি, সামাজিক মর্যাদা ও লোক-লজ্জার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না।

রাজশাহীর এশিয়ান স্কাই শপের মালিক আব্দুল মতিনের বেশ কয়েকটি ব্যাংক চেক কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছেন পলাশ। হাতিয়ে নেওয়া চেক দিয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৩ কোটি টাকার মামলা করেছেন। তবে মামলায় উল্লেখ করেছেন ব্যাবসায়িক লেনদেনের কথা।

তবে নুরুন্নবী জানিয়েছেন, অবৈধ ক্রিপ্টো ট্রেডিং কোম্পানি পিএলসি আলটিমায় মতিন তাকে চার কোটি টাকা বিনিয়োগ করিয়েছেন। কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার তার বিরুদ্ধে ৩ কোটি টাকার মামলা করেছি। আমার কাছে আগে থেকেই তার চেক ছিল। ওই প্রতিষ্ঠানে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কাজ শুরু করার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। তার দাবি, পিএলসি আল্টিমায় তিনি ৪ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাছাড়া তিনি দাবি করেন, তার কৃষি খামার ও আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা আছে। তাছাড়া তিনি যাদের বিনিয়োগ করিয়েছিলেন তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। তবে বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

অবৈধ ক্রিপ্টো ট্রেডিং কোম্পানি পিএলসি আলটিমায় নিজেকে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে আব্দুল মতিন বলেন, নুরুন্নবী পলাশ তার মালিকানাধীন এশিয়ান স্কাই শপে ওর সালার চাকরি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন। তার সালা মিনারুল হক মিঠুকে আমার প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেই। ব্যবসার প্রয়োজনে আমার ১০টি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে। ব্যাগ ভর্তি চেক বই দোকানেই থাকে। এরমধ্যে স্বাক্ষরিত চেকও ছিল। ওই মিঠু সুকৌশলে ব্যাংক চেকগুলো চুরি করে তার বোনের জামাই পলাশকে দিয়েছেন। ওই চেক দিয়ে নিজে ৩ কোটি টাকার মামলা করেছেন।

শুধু নুরুন্নবী পলাশই নয়, একইভাবে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে শিবগঞ্জের তরিকুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের জমশেদ আলী, শাহীন আখতারসহ অন্তত ১০-১৫ জনের নামে। তারা সবাই ডেসটিনির পিএসডি ছিলেন।

তাদের মধ্যে তরিকুলসহ বাকিরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে একের পর এক অবৈধ ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন শুরু করেছেন। একটা বন্ধ হলে আরেকটায় কাজ শুরু করে জেলার বিভিন্ন মানুষের ব্রেনওয়াশ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য জমশেদ আলী ও সাইফুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা এলাকার তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০ কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল প্রতারক তরিকুল ইসলামের নেটওয়ার্ক।

এমটিএফইতে এজেন্ট হিসেবে কাজ করা সদস্যরা বলছেন, তরিকুল ইসলামের ডাউনে ৪০ জন সিইও কাজ করেছেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে তিনি কমিশন পেয়েছেন কোটি টাকা। প্রতারণার টাকায় দেশবিদেশে বিলাসী জীবন-যাপন করেছেন তরিকুল ইসলাম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তরিকুল ইসলাম জানান, আমি ৪ মাস আগেই এমটিএফই ছেড়ে দিয়েছি। র‌্যাবের এক কর্মকর্তা আমাকে এমন প্রতারণার কাজ করতে নিষেধ করেছিলেন। সেই দিন থেকে আমি কোনো প্রোগ্রাম করিনি। আমি আগেই বুঝতে পেরেছি যে, তারা স্ক্যাম করতে পারে। এ জন্য আমি যাদের জয়েন করিয়েছিলাম তাদের পরিষ্কারভাবে বিনিয়োগ উঠিয়ে নিতে বলেছি।

তরিকুল ইসলাম আরও জানান, একজনের ১০০ জন ট্রেডার হলে তিনি সিইও হন। অনেক গণ্ড মূর্খও সিইও পদ পেয়েছেন এমটিএফই’র। চাঁপাইনবাবগঞ্জে মিনিমাম ১০ জন সিইও আছেন। এছাড়া আমার কাছে আর কোনো তথ্য নেই। তবে এমটিএফইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখনও অনেকে তাতে কাজ করছেন বলে স্বীকার করেন।

শাহীন আখতার বলেন, তিনি নিজে ২০১ ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন। নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কাউকে প্রতারিত করতে সেখানে বিনিয়োগ করাননি বলে দাবি তার।

অন্যতম প্রতারণার স্বীকার চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার মতো টাকা খুইয়েছেন অনেকেই। কিন্তু লজ্জায় কেউ মুখ খুলছেন না। তিনি আহম্মেদ আবু আমিন ওরফে আপেল নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে এই অ্যাপের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাতে তিনি এক লাখ টাকা জমা দেন। দুই সপ্তাহে লাভ দেখানো হয় ১৩০ ডলার। এরপর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০০ ডলারে। কিন্তু অ্যাপটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিনিয়োগের টাকা ও লাভ আর উঠাতে পারেননি।

ভুক্তভোগী আহম্মেদ আবু আমিন বলেন, আমি এমটিএফই অ্যাপের মাধ্যমে প্রায় সাত লাখ টাকা হারিয়েছি। প্রথমে কম টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। কিছুদিন লাভ পেয়ে সাত লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। গত বৃহস্পতিবার থেকে অ্যাপটি বন্ধ হয়ে গেছে। আমার মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন বলে জেনেছি।

আহম্মেদ আবু আমিন আরও বলেন, এই অ্যাপে যুক্ত করিয়ে দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ করাতে পারা ব্যক্তিকে বলা হয় সিইও। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ রকম প্রায় ১০ জন সিইও আছেন। তাদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে অফিস খুলে কার্যক্রম পরিচালনা করতেন জমশেদ আলী ও সাদিকুল ইসলাম ওরফে বাবু। সাদিকুল ইসলামের অফিস ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের উপররাজারামপুর মোড়ে। দুই দিন আগে তার অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। তার দাবি এই অ্যাপের সঙ্গে জড়িতদের বেশির ভাগই ডেসটিনির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আবুল কালাম সাহিদ বলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি বিদেশি অ্যাপে অথবা এমটিএফই এর মাধ্যমে প্রতারণার শিকার কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করেননি। এমন অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শুনেছি অনেকে প্রতারণার শিকার হয়ে টাকা হারিয়েছেন। তবে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০২৩
এফআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।