ঝালকাঠি: রাসেলের বেতনের টাকার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল তার পরিবার। ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচও চালাতো রাসেল।
রাসেলের ইচ্ছে ছিল, বেতন থেকে সামান্য করে হলেও টাকা জমিয়ে নিজেদের একটি ঘর তৈরি করার। এরপর সেই বাড়িতে উঠে বিয়ে করার। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। রাসেলের স্মৃতিই এখন তার বাবা, মা, বোন ও ভাইয়ের একমাত্র সম্বল।
গাজীপুর মহানগরের গাছার কলম্বিয়া এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন রাসেল। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে তার সঙ্গে ছিলেন একই প্রতিষ্ঠানের কর্মী মো. সুফিয়ান। তিনি জানান, কারখানায় রাসেল ও তিনি একই পদে চাকরি করতেন। তাদের কারখানায় কোনো আন্দোলন হয়নি। কিন্তু অন্য কারখানায় আন্দোলনের কারণে মালিকপক্ষ তাদের দ্রুত ছুটি দিয়ে দেন। তারা কারখানা থেকে বাসায় যাওয়ার পথে পুলিশের গুলিতে আহত হন রাসেল। প্রথম গুলিটি তার বুকের ডান পাশে আর দ্বিতীয় গুলিটি হাতে লাগে। তখন রাসেল ‘মা’, ‘বাবা’ বলে চিৎকার করে অচেতন হয়ে পড়েন। তিনি রাসেলকে উদ্ধার করে টঙ্গী হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু পথেই তার মৃত্যু হয়। সুফিয়ান বলেন, ‘রাসেল খুব শান্ত ও পরিশ্রমী ছিলেন। কষ্ট করে খেয়ে, না খেয়ে টাকা জমাতেন। আমার কাছে বলতেন, ১৩ হাজার টাকা বেতনের এই টাকা দিয়ে কবে বাড়িতে ঘর তুলতে পারব। মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকেও টাকা ধার নিত। ’ রাসেল (২৪) ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগড়া বাইপাস এলাকার এনার্জিপ্যাক ডিজাইন গার্মেন্টসের ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন। তার বাড়ি ঝালকাঠি সদর উপজেলার বিনয়কাঠি ইউনিয়নের বালকদিয়া গ্রামে। সেখানে থাকে তার পরিবার।
ছেলে হারানোরা শোকে মূর্ছা যেতে যেতে বাবা বলেন, ‘আমার সোনার ছেলে পৃথিবী থেকে চলে গেছে। আমি এখন কাকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধব। কার সঙ্গে কী বলব, বলেই বা কী হবে। ’ এভাবেই বলছিলেন আর বিলাপ করছিলেন পুলিশের গুলিতে নিহত পোশাক শ্রমিক রাসেল হাওলাদারের বাবা হান্নান হাওলাদার।
বুধবার (০১ নভেম্বর) রাসেলের গ্রামের বাড়িতে গেলে এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়। উঠতি বয়সী যুবক রাসেলের মৃত্যুতে যেন এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
রাসেলের বাবা হান্নান হাওলাদার কাঠ বিক্রির ছোট ব্যবসা করেন। সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। রাসেল বড়। ছোট ছেলে নাইম হাওলাদার দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। নিজেদের বাড়ির বাগানেই রাসেলকে চিরতরে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এইচএসসি পাস করার পর টাকার অভাবে রাসেলের আর পড়াশোনা হয়নি। তাই কাজ পেয়ে ঢাকায় চলে যান। তার পাঠানো টাকায় তিন বছর আগে একই গ্রামে নিজেদের জমিতে ঘর তৈরির কাজ শুরু করে পরিবারটি। রাসেলের বাবা সেই নির্মাণাধীন ঘর দেখিয়ে বলছিলেন, ‘এই ঘর আর হবে কিনা, জানি না। সংসারের অভিভাবক ছিল রাসেল। আমার সচ্ছলতা থাকলে ওকে আমি চাকরি করতে দিতাম না। ছেলে নিরপরাধ হয়েও পুলিশের গুলিতে মারা গেল। আমি এর বিচার চাই। ’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রাসেলের বাবা আরও বলেন, ‘ছোট ছেলে নাইমের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ বহন করত রাসেল। কত টাকা বেতন পায়, কোনোদিন জানতে চাইনি। আমার সঙ্গে শেষ কথা হয় ২৯ অক্টোবর রাতে। ’
রাসেলের মা রাশিদা বেগম বলেন, ‘আমাকে বাবায় বলছে– মা, আমি ডিসেম্বরে আসব। তোমার জন্য কী আনব জানাবা। আমি বলছি– তুমি সহিসালামতে ফিরে আসো। এইডাই আমি চাই আল্লাহর কাছে। ’ একমাত্র বোন মিম আক্তারের সব সময় খোঁজ নিতো রাসেল। সেই কথা বলে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছে মিম। সে বলে, ‘আর ভাই আমাকে ফোন করবে না। ’
মাসিক বেতন ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে এক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছেন পোশাক শ্রমিকরা। সোমবার সকালেও বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষে গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া বাইপাস, কোনাবাড়ী, মালেকের বাড়ি, চান্দনা চৌরাস্তা, বোর্ডবাজারসহ ১০টি এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মালেকের বাড়ি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন রাসেল। মঙ্গলবার রাত সোয়া ৮টার দিকে বালকদিয়া গ্রামের বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০২৩
আরএ