কক্সবাজার: কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং দুই ইস্ট শরণার্থী শিবিরে পাহাড়ের ঢালুতে বসবাস করেন ওমর ফারুক (১৮) ও সাবেকুন্নাহার (১৬)। এ কিশোর বয়সেই দুজন এখন স্বামী স্ত্রী।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি পরিবারে তিন থেকে ১০টি সন্তান। কোনো কোনো পরিবারে আরও বেশি। বাল্যবিয়ে ও বহু বিয়ের প্রবণতাও খুব বেশি। এভাবে গত পাঁচ বছরে শিবিরে জন্ম হয়েছে প্রায় দেড় লাখ শিশু।
তবে কুসংস্কার, অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে শুরুর দিকে কয়েক বছর প্রতি মাসে ৩২ থেকে ৩৫ হাজারের বেশি শিশুর জন্ম হলেও এখন তা গড়ে ২৭-২৮ হাজারে নেমে এসেছে বলে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের এর স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু তোহা।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রোহিঙ্গা আগের চেয়ে অনেক সচেতন এ কথা জানিয়ে ডা. আবু তোহা বলেন, শিবিরগুলোতে নিরাপদ এবং সিজারিয়ান ডেলিভারি পর্যাপ্ত না থাকায় শিশু মৃত্যুর হার বেশি। এ সেবা বাড়ানো গেলে জন্মহার আরও কমে আসতো।
তবে জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জন্ম নিয়ন্ত্রণে আগ্রহ বাড়ছে ‘রোহিঙ্গারা বছর বছর সন্তান জন্ম দেন, ক্যাম্পের নারী-পুরুষের সন্তান নেওয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই’ তাদের নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ এমন ধারণা পোষণ করলেও এখন বদলে যাচ্ছে সেই চিত্র। নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ এখন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিও গ্রহণ করছে।
বাল্যবিয়ের শিকার কিশোর ওমর ফারুক বলেন, আমরা অল্প বয়সে বিয়ে করেছি, কিন্তু এখনই সন্তান নিচ্ছি না। সন্তান না হওয়ার জন্য আমার স্ত্রী এখন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাচ্ছেন।
অল্প বয়সে সন্তান নিলে স্ত্রী সামলাতে পারবে না জানিয়ে ওমর বলেন, সন্তান নিলে স্ত্রী ও সন্তানের ক্ষতি হতে পারে।
২০২১ সালে বিয়ে করেছেন এ কথা জানিয়ে তার স্ত্রী সাবেকুন্নাহার বাংলানিউজকে বলেন, আমার বয়স এখনো ১৬। স্বাস্থ্যকর্মী ভাই-বোনদের কাছে শুনেছি ১৮ বছরের আগে সন্তান নিলে ক্ষতি হতে পারে। তাই আমি এবং আমার স্বামী সিদ্বান্ত নিয়েছি দুই বছর পরে সন্তান নেব। এখন পিল খাচ্ছি।
কুতুপালং দুই ইস্ট রোহিঙ্গা শিবিরের এ ব্লকে স্বামী ও পাঁচ সন্তান নিয়ে বসবাস করেন ফাতেমা বেগম (৩৫)। ফাতেমা বলেন, ২০১৭ সালে স্বামীর সঙ্গে দুই সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি। এখানে এসে তিন সন্তানের জন্ম হয়েছে। সবচেয়ে ছোট সন্তানের বয়স এখন দেড় বছর। ‘আমরা সিদ্বান্ত নিয়েছি আর সন্তান নেব না। তাই পাঁচ বছরের জন্য গর্ভধারণ প্রতিরোধ করতে ‘ইমপ্ল্যান্ট’ করিয়েছি,’ যোগ করেন ফাতেমা।
একই ব্লকের ইমতিয়াজ খাতুন (২১) বাংলানিউজকে বলেন,‘বিয়ের পর পরই আমি ইমপ্ল্যান্ট করিয়েছি। ডিপো মারতে চেয়েছিলাম। স্বাস্থ্যকর্মী আপারা মানা করেছেন। আমি তাদের বলেছি, আপনারা যেটি ভালো মনে করেন সেটি দেন। তখন তারা আমাকে ইমপ্ল্যান্ট দেন। এটিকে আমরা ‘সুইচ’ বলি। পরে আমার স্বামী এটি বের করে ফেলতে বললে, বের করে সন্তান নিয়েছি।
বাচ্চা প্রসবের পরে আবারও জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন জানিয়ে ইমতিয়াজ বলেন, সন্তান প্রসবের পর প্রথমে স্বামী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে রাজি হচ্ছিল না, পরে স্বাস্থ্যকর্মীরা এসে বুঝিয়ে বললে আমার স্বামী রাজি হন।
‘শুরুর দিকে এনজিও কর্মীদের পক্ষ থেকে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি জানিয়ে এ ব্লকের মাঝি (নেতা) মো. তৈয়ব (৪৫) বাংলানিউজকে বলেন, মিয়ানমারে থাকতে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো না। এখানে শুরুর দিকে না হলেও চার-পাঁচ বছর ধরে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
‘প্রশিক্ষণ পেয়ে অনেক রোহিঙ্গা নারী পুরুষ এখন পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন জানিয়ে এ রোহিঙ্গা নেতা বলেন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পার্টনার্স ইন হেলথ অ্যান্ডড ডেভেলপমেন্ট (পিএইচডি) নামের একটি এনজিওর সচেতনতামূলক কর্মসূচির কারণে এ ব্লকের ৫৫ পরিবারের বেশির ভাগ সক্ষম দম্পতি এখন পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি মেনে চলছে।
তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বারবার বোঝানোর পরও করতে রাজি হননি একই শিবিরের আবু তাহেরের স্ত্রী ফাতেমা আকতার (৪০)। ফাতেমার ভাষ্য, মিয়ানমারে বুচিডং থেকে তারা এখানে এসেছেন। মিয়ানমারে এসব সুবিধা ছিল না। ‘আমার স্বামী গুনাহকে ভয় করে। স্বামী মনে করে, এসব করলে গুনাহ হবে। তাই তাকে বারবার বোঝানো হলেও স্বামী রাজি হননি। ’
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে এবং আগে আসা নতুন পুরোনো মিলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে কক্সবাজারের উখিয়ার টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে। তবে জাতি সংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর তথ্য মতে শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার।
উখিয়ার বিভিন্ন শিবিরের জন্ম নিয়ন্ত্রণ, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে কাজ করছে পার্টনার্স ইন হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (পিএইচডি) নামে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা।
সংস্থাটির মাঠকর্মী সাবরিনা আকতার খুকি বেনারটা বাংলানিউজকে বলেন, শুরুর দিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নানা কুসংস্কার ও অজ্ঞতা কাজ করতো। ‘এগুলো করলে গুনাহ হবে। আল্লাহ দিচ্ছে নেব না কেন, খাওয়ানোর মালিক আল্লাহ’ এসব কথাবার্তা বলা হতো আমাদের। এখন সেই ধারণা পাল্টেছে।
‘ছোট পরিবার হলে কি হবে, পরিবার বড় হলে কি হবে রোহিঙ্গাদের তা বোঝানো হয়। এর পর রাজি হলে যার যে পদ্ধতি প্রয়োজন সেটা আমরা দেই। বিশেষ করে কম বয়সী নব দম্পতিদের আমরা, অল্প বয়সে সন্তান নিলে কি বিপদ হতে পারে তা তুলে ধরি। ’ বলেন সাবরিনা।
শিবিরজুড়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৭১ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করছে বলে দাবি একই সংস্থার সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর ডা. মো. ড্যানিয়েল হোসাইনের।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৮-১৯ জন সন্তান আছে এমন পরিবারও দেখেছি। আমরা তাদের বোঝাই একটি পরিবারের সাইজ কি রকম হতে পারে।
‘প্রথম দিকে আমরা রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলতাম না, এখন আমরা সে পদ্ধতিতে জোর দিচ্ছি এবং খুব ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
ভবিষ্যতে জন্মনিয়ন্ত্রণের হার আরও বাড়বে জানিয়ে ডা. ড্যানিয়েল বলেন, বর্তমানে আমরা নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের জন্মনিয়ন্ত্রণেও জোর দিচ্ছি। পর্যায়ক্রমে পুরুষদের মাঝেও জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহীর হার বাড়ছে।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে তথ্য মতে, চার বছর আগেও রোহিঙ্গা পুরুষেরা কনডম ব্যবহারে আগ্রহী ছিলেন না। এখন সক্ষম দম্পতির মধ্যে ৬০ শতাংশ পুরুষ কনডম ব্যবহার করছেন। অথচ পাঁচ বছর আগে এ হার ছিল মাত্র সাত শতাংশ। একইভাবে রোহিঙ্গা নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি গ্রহণের হারও বেড়ে এখন প্রায় ৫০ শতাংশ হয়েছে। তিন মাস মেয়াদি ইনজেকশন এবং দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি গ্রহণেও রোহিঙ্গারা আগ্রহী হচ্ছেন।
কক্সবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. আবুল কালাম বাংলানিউজকে বলেন, অক্টোবর মাস পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে সক্ষম দম্পতির সংখ্যা ছিল ৯৮ হাজার ২০৭ জন। চলতি মাসে নতুনভাবে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে দুই হাজার ১৮৩ জন। এ নিয়ে অক্টোবর পর্যন্ত মোট পদ্ধতি গ্রহণ করেছে ৭১ হাজার ৯০৬ জন। যা শতকরা হিসাবে ৭৩ দশমিক ২২ শতাংশ।
তিনি বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে ২০টির বেশি এনজিও পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাউন্সেলিং ছাড়াও বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ছয়টি মেডিকেল টিমের সেবা পাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
তবে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের কারণে এ সফলতা বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ শামসু দ্দৌজা।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গারা যখন এদেশে আসে তখন মানবিক কারণে তাদের আমরা আশ্রয় দেই। শুরুর দিকে জীবন বাঁচানোর সেবাগুলোর প্রতি জোর দেওয়া হয়।
‘আমরা জরিপে দেখেছি প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু যোগ হচ্ছে তখন জন্মনিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া হয়। এখন বেশ ভালোই সাড়া পাওয়া যাচ্ছে ‘ যোগ করেন শামসু দ্দৌজা।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, ইউএনএফপিএ, ইউএনএইচসিআরসহ জাতি সংঘের বিভিন্ন সংস্থা এখন এটি নিয়ে কাজ করছে জানিয়ে শামসু দ্দৌজা বলেন, শুরুর দিকে একটু বেগ পেতে হলেও এখন জন্মনিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গাদের আগ্রহ বাড়ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২৩
এসবি/আরআইএস