ফেনী: ভালো নেই শহর- জনপদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকারী হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ। কায়িক শ্রমের অল্প আয়ে কিছুতেই যেন চলে না জীবিকার চাকা।
নিশুতি রাত, শহরবাসী যখন ঘুমের প্রস্তুতিতে, তখন কিছু মানুষ জেগে। হাতে ঝাড়ু, কপালে জীবিকার চিন্তার ভাঁজ। বলছি হরিজন সম্প্রদায়ের কথা। যারা ঝকঝকে রাখেন শহর, নগর ও জনপদ। কিন্তু তাদের জীবনটা কেমন-পরিচ্ছন্ন শহরের মতই দীপ্তি ছড়ানো, নাকি অন্যরকম।
ফেনী পৌর শহরের ১৮টি ওয়ার্ডের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য নিয়োজিত আছেন ৪ শতাধিক পরিচ্ছন্নতা কর্মী। পরিবাররের অন্য সদস্যরা মিলিয়ে তাদের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
শহরের রেলওয়ে স্টেশন ও সুলতানপুর ও শহরের কোর্ট বিল্ডিং এলাকার কয়েকটি কলোনিতে মানুষগুলোর বসবাস। কোনো রকমে খুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকলেও নানারকম কষ্টে কাটে তাদের জীবন। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, মেয়ে জামাই ও আত্মীয় স্বজনসহ পরিবারের ১০ জন হলেও একটি কক্ষেই করতে হয় বসবাস। আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসার অপ্রতুলতায় ভোগান্তি তাদের নিত্যসঙ্গী। সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ হাজার টাকায় কিছুতেই যেন চলে না জীবনের চাকা।
সাধনা হরিজন নামের একজন জানালেন ছেলে- মেয়ে বড় হয়েছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেও বিয়ে উপযুক্ত। ঘরে মানুষ ৮ হলেও থাকার ঘর একটাই। মনিকা নামের আরেকজন জানালেন বহু কষ্টে কলেজ পার করেছেন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। শিক্ষার জন্য কম সংগ্রাম করতে হয়নি তাকে। কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে কাটাতে হয়েছে জীবন।
সমাজের কোন সম্প্রদায়কে বাকি রেখে একটি সভ্যতা বিকশিত হতে পারে না। সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তনে এদের জীবনেরেও পরিবর্তনের দরকার বলে মনে করছেন দৈনিক ফেনীর সম্পাদক ও গবেষক আরিফুল আমীন রিজভী ।
শহর জনপদকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সমাজের মানুষের জীবনকে সুন্দর করে তুললেও সেই মানুষদের কাছেই তারা অচ্ছুত। এখনো ছোট করে দেখা হয় এই হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষদের। তাদের সাথে বসে খেতে কিংবা চলাফেরা করতে চায় না অনেকে। অনেকেই ভাবেন তারা নিচু তলার মানুষ।
অনিল নামের আরেকজন জানান, এত কম টাকায় চাকরি সম্ভবত আর কোনো পেশায় নেই। ঘরে চাল আনলে নুন থাকে না। নুন আনলে তরকারি থাকে না। কিছুতেই যনে লাগাম টানা যায় না।
এদিকে কাজের পারিশ্রমিক বাড়ানোসহ তাদের জীবনমান উন্নয়নে নানা উদ্যোগের কথা জানালেন ফেনী পৌরসভার মেয়র। নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী। তিনি জানান, তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। আবাসনের জন্য বহুতল ভবনের বিষয়টিও মাথায় রয়েছে।
বাংলাদেশে বসবাসকারি অবাঙালি দলিতদের সাধারণভাবে হরিজন বলা হয়। ব্রিটিশ আমলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা (১৮৩৮-১৮৫০), চা-বাগানের কাজ (১৮৫৩-৫৪), জঙ্গল কাটা, পয়োনিষ্কাশন প্রভৃতি কাজের জন্য ভারতের নানা অঞ্চল থেকে দরিদ্র দলিত মানুষকে এ দেশে আনা হয়। তাদের থাকতে দেওয়া হয় কাজের জায়গায়, কলোনিতে। এদের কাছ থেকে সেবা নেওয়া যাবে, কিন্তু ছোঁয়া যাবে না। সেলুন, রেস্তোরাঁ, রেলের কামরা, স্কুল–কলেজ পরিষ্কার করবে এরা।
বলা হয়, কথিত এসব ‘অচ্ছুত’ মানুষকে সম্মানজনক অবস্থান দেওয়ার জন্য মহাত্মা গান্ধী তাদের নাম দিয়েছিলেন হরিজন। মানে ঈশ্বরের সন্তান। কালের বিবর্তনে তারাই ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন শহরে।
অবহেলিত-বঞ্চিত জীবনে আলো ফিরুক, সংকট দূর হয়ে জীবন হোক সহজ। এমনটাই প্রত্যাশা মানুষগুলোর।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩
এসএইচডি/জেএইচ