ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজে দুর্নীতি

বরখাস্তকৃত শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘বহাল’ রেখে অর্থ লোপাট

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩
বরখাস্তকৃত শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘বহাল’ রেখে অর্থ লোপাট

ঢাকা: শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ থেকে গত ১৯ বছরে সতেরজন শিক্ষক-কর্মচারীকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বরখাস্ত করা হয়েছিল। যেকোনো অভিযোগ উঠলেই তাদের বরখাস্ত করা হতো।

প্রতিষ্ঠানের ‘দুষ্টু’ ব্যক্তিরা সিন্ডিকেট করে তহবিল থেকে অর্থ তুলতেন। বরখাস্তকৃতদের কিছু পাওনা মিটিয়ে বাকিটা নিজেদের পকেটে পুরতেন।

জানা গেছে, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল বেশ কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারীকে। তাদের আবার হেনস্তার শিকারও হতে হয়েছে। বরখাস্তকৃত শিক্ষকদের পুনর্বহাল করে তহবিলের টাকা ভাগবাটোয়ারা করা এ প্রতিষ্ঠানে ডাল-ভাত। কলেজ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় পারিবারিক মামলায় এক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করতে পুলিশকে সহযোগিতার অভিযোগও আছে অন্যান্য শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।

শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের কয়েকটি সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আর নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া কয়েকজন শিক্ষক বলেছেন, শিক্ষকদের হয়রানি, বরখাস্তের নামে নির্যাতন, বিশৃঙ্খলা করায় একসময়ের সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ঐতিহ্য হারাচ্ছে।

কবে থেকে শুরু বরখাস্তকাণ্ড?

জানা গেছে, প্রিন্সিপাল মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর পরবর্তী সময় থেকে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজে শিক্ষক বরখাস্তকাণ্ড শুরু হয়।

২০০৩ সালে তৎকালীন অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বরখাস্ত হন। পরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন কামরুন নাহার আহমেদ এক শিক্ষক। তিনি ক্ষমতা পেয়ে ২০০৪ সালে মো. ফরিদ হোসেন নামে এক শিক্ষককে বরখাস্ত করেন। ২০০৭ সালে তার খড়্গ পড়ে আরও ৮ শিক্ষক-কর্মচারীর গলায়। ভুক্তভোগীরা ২০০৯ সালে আদালত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির সুপারিশে স্বপদে বহাল হন।

বরখাস্ত হওয়া থেকে স্বপদে বহাল হওয়া পর্যন্ত দুই বছরে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ ওই আটজনের কাছ থেকে কোনো সেবা না পেলেও নিজেদের পাওনা পেয়েছেন। প্রায় দুই কোটি টাকা কলেজ তহবিল থেকে তাদের দেওয়া হয়। এই অর্থ প্রদানের সময় লোপাটও কয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০১৫ সালে অধ্যক্ষ পদে মো. আব্দুর রহমান নামে এক শিক্ষক নিযুক্ত হয়ে কলেজের দুর্নীতিতে যুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। সিন্ডিকেটটি তাদের আওতায় না আসা শিক্ষকদের নিয়ে ‘গেম’ খেলতেন। কেউ কথা না মানলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতেন সিন্ডিকেটের লোকজন। অভিযোগকারীদের হয়রানির পর বরখাস্ত করা হতো। ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী। তাদের পাওনা পরিশোধ করতে কলেজ তহবিল থেকে অর্থ তোলেন সিন্ডিকেটের লোকজন। বরখাস্তদের স্বপদে ফিরিয়ে নিতে তহবিল থেকে তোলা অর্থ ‘গায়েব’ করে দিতেন সিন্ডিকেটকারীরা।

মোহাম্মদ তানভীর আহমেদ নামে কলেজের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের এক নারী কর্মচারীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানাবিধ অভিযোগে তৎকালীন কলেজ পরিচালনা পরিষদ তাকে দোষী সাব্যস্ত করে বরখাস্ত করে। তিনি আবার অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রহমানের মদদপুষ্ট। সাবেক ছাত্র হওয়ায় শাস্তি না দিয়ে তানভীরকে বহাল করা হয়। এ ক্ষেত্রেও ‘দুই নম্বরি’ করেছে কলেজটির সিন্ডিকেট সদস্যরা।

সূত্র জানিয়েছে, তানভীর বরখাস্ত হয়েছিলেন পুরনো পরিচালনা পরিষদ বহাল থাকাকালীন। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন পরিচালনা পরিষদ এলে আব্দুর রহমান তার সিন্ডিকেটের সদস্যদেরকে দিয়ে তানভীরের ব্যাপারে তদন্ত কমিটি করে। সেই কমিটির প্রতিবেদন আমলে নিয়ে তানভীরকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়। বরখাস্ত হওয়ার সময় পাওনা বাবদ তানভীরকে কলেজ তহবিল থেকে ২৮ লাখ টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু এ টাকার বড় একটা অংশ অধ্যক্ষ ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিয়ে নেন।

এ সংশ্লিষ্ট কিছু প্রমাণ ও ভিডিও আছে বাংলানিউজের এ প্রতিবেদকের কাছে।

শিক্ষক তানভীরের বিষয়টি নিয়ে যে কমিটি করা হয়েছিল, সেটিতে ছিলেন কলেজ পরিচালনা পরিষদের সদস্য তাসলিমা বেগম। তিনি বলেন, কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আমি যে সিদ্ধান্তটা দিয়েছিলাম, তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণিত হয়েছে তানভীর দোষী। যখন আমি চলে এসেছি তখন মেয়েটা নাকি অভিযোগ তুলে নিয়েছে। ফলে তারা তানভীরকে পুনর্বহাল করেছে। পাওনাদি বুঝিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা লিখিত অভিযোগ করে ফাঁদে ফেললো আবার অভিযোগ তুলে নিলো! মেয়েটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন? আর এখন যদি বলে তানভীরের তদন্ত সঠিক হয়নি, তাহলে আমাকে কেন জানানো হয়নি? আমি অধ্যক্ষকে ধরব।  

তিনি আরও বলেন, আমি শুনছি এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের একটা সিন্ডিকেট আছে। শিক্ষকরা সিন্ডিকেট করে হয়রানি, বরখাস্ত করে, যা খুবই দুঃখজনক, লজ্জাজনক। তবে অন্যায় করলে শাস্তি দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সিন্ডিকেট থাকলে প্রতিষ্ঠানের মান মর্যাদা থাকে না।

নিজেকে একজন ভুক্তভোগী বলে দাবি করে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান অভিযোগে বলেন, এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টার মিথ্যা অভিযোগ এনে প্রথমে কারণ দর্শানো, পরে বরখাস্ত করা হয় আমাকে। এটা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে করা হয়। কারণ দর্শানো ও বরখাস্ত করার চিঠিতে কোনো মিল নেই। চিঠিতেই প্রমাণ করে তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আমাকে বরখাস্ত করেছে। এর আগেও অকারণে আমাকে হয়রানি করা হয়েছিল।

ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা ও বরখাস্ত করার চিঠি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুই চিঠির মধ্যে তথ্যের গড়মিল রয়েছে। কারণ দর্শানোর চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘ছাত্রীকে আপনার বিভাগে ডেকে নিয়ে কৌশলে বিভাগ জনশূন্য করে তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। ’ বরখাস্ত করার চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘শ্লীলতাহানি, বিনা অনুমতিতে অন্য কলেজের ছাত্রীকে শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া এবং কর্তৃপক্ষের অবাধ্যতার অভিযোগে বরখাস্ত করা হলো। ’

কারণ দর্শানোর নোটিশ শুধু ‘শ্লীলতাহানির চেষ্টার’কথা বলা হলেও বরখাস্ত করা চিঠিতে লেখা হয়েছে ‘শ্লীলতাহানি’। একইসঙ্গে আরও দুটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে শিক্ষা সফরে অন্য ছাত্রীকে নিয়ে যাওয়া ও কর্তৃপক্ষের অবাধ্যতার অভিযোগ। যা কারণ দর্শানোর চিঠিতে নেই।

তথ্য প্রমাণাদি ঘেঁটে দেখা গেছে, মাকসুদুর রহমান অন্য কলেজের কোনো ছাত্রীকে শিক্ষা সফরে নিয়ে যাননি। কলেজের একাংশ শিক্ষকের দাবি, প্রতিষ্ঠানের সমস্ত অপরাধের মদদ দিচ্ছেন প্রিন্সিপ্যাল ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

মুন্সি মোহাম্মদ শাহীন নামে এক শিক্ষকও এ কলেজ থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জোর যার মূল্লুক তার এভাবেই সব চলছে। আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে- এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।

বরখাস্ত হওয়া মোহাম্মদ তানভীর আহমেদের বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ও শিক্ষক প্রতিনিধি আসমা পারভীন বলেন, কেউ অন্যায় করলে তো দরখাস্ত হবেই। আর কলেজের কথা বলতে আমি বাধ্য নই। অধ্যক্ষকে কল দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন।

এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রহমান সব অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, সব মিথ্যা কথা। আমার কলেজে এমন কোনো ঘটনা নেই। এ কলেজে শিক্ষকদের কোনো সিন্ডিকেট নেই। অকারণে কাউকে হয়রানি, বরখাস্ত করা হয় না। যারা অপরাধ করছে তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমার আমলে কোনো শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়নি। কাউকে বরখাস্ত করার পরে অভিযোগ যদি প্রমাণিত না হয়, সে আবার স্বপদে বহাল হয়। কাউকে বহাল করেও টাকা ভাগাভাগিও করা হয়নি। তানভীর বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত করে কিছু পাওয়া যায়নি। তাই তাকে বহাল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩
এমএমআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।