কক্সবাজার: কক্সবাজারের রামুর প্রায় দেড়শ বছরের প্রাচীন কাঠের তৈরি উসাইচেন বড় ক্যাং বৌদ্ধ বিহারে গত শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাতে যখন অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, এর মাত্র ২০ মিনিট আগে রামু ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে ফোন করে জানানো হয় ঈদগড় বাজারে আগুন লেগেছে।
এমন খবরে স্টেশন কর্মকর্তা সৌমেন বড়ুয়ার নেতৃত্বে দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে ঈদগড়ের উদ্দেশে রওনা হয়।
এরই মধ্যে রাত ২টার পর পর রামু সদরের চেরাংঘাটা এলাকায় ওই বৌদ্ধ বিহারে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। স্থানীয় লোকজন দ্রুত আগুন নেভাতে এগিয়ে আসায় এবং দমকল বাহিনীর সহায়তায় আগুন দ্রুত নেভানো সম্ভব হয়। ফলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বিহারটির দোতলায় ওঠার সিঁড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। জাতীয় নির্বাচনের আগের এমন নাশকতার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। বিষয়টি সারা দেশে আলোচিত হয়।
ঘটনার পর দিন শনিবার (৬ জানুয়ারি) বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মংকিউ রাখাইন বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে রামু থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুনয়ন বড়ুয়া।
সেই বহুল আলোচিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মো. আব্দুল ইয়াছির ওরফে শাহজাহান (২৩) নামে এক যুবককে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ এলাকা থেকে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয়।
মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থেকে তাকে গ্রেপ্তারের পর তার স্বীকারোক্তি মতে, বুধবার সন্ধ্যায় রামুর ফতেখাঁরকুলের হাইটুপি ভূতপাড়ায় অভিযান চালিয়ে ঘটনার দিন রাতে ব্যবহৃত সেই সিমটি উদ্ধার করা হয়। এসময় পুলিশের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
গ্রেপ্তার হওয়া যুবক ইয়াছির রামু উপজেলা ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের পূর্ব মেরলোয়া গ্রামের বাসিন্দা ও ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল করিমের ছেলে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে অভিযানে থাকা ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ভুট্টো বাংলানিউজকে বলেন, যে মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার করে ভুয়া আগুন লাগার খবর দেওয়া হয়েছিল, ইয়াছিরের দেখিয়ে দেওয়া স্থান থেকে সেই সিম কার্ডটি উদ্ধার করে পুলিশ। তবে অনেক খোঁজাখুজির পরেও ব্যবহৃত ফোন সেটটি পাওয়া যায়নি।
চেয়ারম্যান ভুট্টো আরও জানান, আভিযানের সময় ইয়াছিরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ঘটনার দিন ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলার পরই ফোন এবং সিম আলাদা আলাদা করে ফেলে দেন তিনি। সিমটি যে স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তার উল্টো দিকে কচু ক্ষেতে সেটটি ছুঁড়ে ফেলা হয় বলে সে জানিয়েছে। কাল দিনের আলোতে সেটটি খোঁজার জন্য লোক পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।
ইয়াছির নিজেই বিহারে আগুন দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন জানিয়ে ভুট্টো বলেন, বিহারে কেন আগুন দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না। ’
তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের আগে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবু তাহের দেওয়ান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি বিস্তারিত জানাবেন। এর আগে এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।
তবে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন হয়। এর আগে ৫ জানুয়ারি রাতে এ নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা দেড় দুই মাস আগে থেকে করেন ইয়াছির। সেই পরিকল্পনা মতো তিনি নিজেই বৌদ্ধ বিহারে আগুন দেন।
পুলিশের এ সূত্র আরও জানায়, অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলামের নির্দেশে এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে রামু থানার ওসি মো. আবু তাহের দেওয়ান, ওসি (তদন্ত) ইমন চৌধুরী, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সুনয়ন বড়ুয়াসহ পুলিশের একটি দল সেই ফোন কলের সূত্র ধরে ঘটনার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে। পরে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই ফোন ব্যবহারকারী এবং অগ্নিকাণ্ডের মূলহোতাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয় পুলিশ।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে এ নাশকতা চালানো হয়।
বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মংকিউ রাখাইন বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে রাত ২টা ৬ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের দিকে বিহারের পাশের মাঠ দিয়ে অজ্ঞাত এক লোককে বিহারের দিকে আসতে দেখা যায় এবং দুই আড়াই মিনিট পরই ওই লোকটিকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।
বিহার পরিচালনা কমিটির নেতারা জানান, দৃষ্টি নন্দন নির্মাণ শৈলীতে কাঠের তৈরি এটিই এখন সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিহার। এ বিহারটি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশেই সেদিন ফায়ার সার্ভিসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঈদগড়ে পাঠানো হয়। তার পরিকল্পনা ছিল, বড় ধরনের নাশকতা চালানো।
ফোনের বিষয়টি নিশ্চিত করে রামু ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা সৌমেন বড়ুয়া জানান, শুক্রুবার ( ৫ জানুয়ারি) রাত ১টা ৪২ মিনিটের দিকে অফিসের নম্বরে ফোন করে জানানো হয়, ঈদগড় বাজারে আগুন লেগেছে। ফোন পেয়ে ১টা ৪৫ মিনিটেই আমরা ঈদগড়ের উদ্দেশে রওয়ানা হই। রওনা দেওয়ার পর ওই নম্বরে ফোন করে সঠিক লোকেশন জেনে নিই। কিন্তু সেখানে পৌঁছে জানতে পারি, কোনো অগ্নিকাণ্ড ঘটেনি।
সেখান থেকে ২টা ৪৫ মিনিটে রামু পৌঁছাই। পৌঁছেই ফোন পাই, রামু চেরাংঘাটা বৌদ্ধ বিহারে আগুন লেগেছে। তখনই বিষয়টি আমার সন্দেহজনক মনে হয়েছে। ঘটনাস্থলেই আমি বিষয়টি রামু থানার ওসিকে জানাই।
বাংলাদেশ সময়: ০১১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২৪
এসবি/এসআই