মেহেরপুর: গাংনী উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের যুবক তুহিন আলী। বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান।
তাকে ভালো বেতনে কোম্পানির কাজ দেওয়ার কথা বলেছিলেন রাজু। কিন্তু সেখানে গিয়ে তুহিন পড়ে যান মহাবিপাকে। তুহিন আলী মোবাইল ফোনে জানান, মালেশিয়া আসার পর কয়েকজন লোক নিয়ে যায় রাজধানীর কুয়ালালামপুরের সালাক সালাতান নামের একটি ক্যাম্পে। সেখানে তার মত তিন শতাধিক যুবক বন্দী আছে।
মালয়েশিয়ায় আটকে থাকা ভুক্তভোগীদের কয়েকজন জানান, স্থানীয় গাংনী উপজেলার সাহেবনগর গ্রামের কেএনএসএইচ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান শিক্ষক মাজেদ মাস্টার, কাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য শরিফুল ইসলাম ওরফে ন্যাড়া, বালিয়াঘাট গ্রামের আনিসুল হক মাস্টারের ছেলে শোভন, সাহেবনগর গ্রামের সুরজ ও তার ভাই আওয়াল এবং ইঞ্জিনিয়ার মুসা কলিমের মাধ্যমে ঢাকায় নাভিরা ও মুসাকলি এন্টারপ্রাইজ এজেন্সির মাধ্যমে টাকা দিয়ে ভালো কাজের আশ্বাসে তারা মালয়েশিয়ায় আসেন। কিন্তু তিন থেকে ছয় মাসেও দালাল চক্রের সদস্যরা তাদের কোনো কাজ দিতে পারেনি। দালাল চক্রের পক্ষ থেকে প্রথমে খাবার ও পানি দেওয়া হলেও এখন সেটাও বন্ধ করে দিয়ে টাকা দাবি করা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে বিভিন্নভাবে প্রাণনাশের হুমকি।
ক্যাম্পে আটকে থাকা যুবকেরা বলেন, আমরা ৫/৬ মাস আগে এখানে এসেছি। আমাদেরও এই ক্যাম্পে আটক রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই এসব দালালের মাধ্যমে সহায় সম্বল বিক্রি করে চার মাস আগে মালয়েশিয়া এসে আটকা পড়ে আছে এই ক্যাম্পে।
কাজীপুর গ্রামের গোলাম বাজার এলাকার বজলুর ছেলে মাজেদ মাস্টারের হাতে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যান ওই গ্রামের কাদের হেলালের ছেলে আনারুল ইসলাম। তিনি বলেন, শুধু আমি নয়, মাজেদ মাস্টারের হাত ধরে এলাকার তিন শতাধিক যুবক মালয়েশিয়া এসেছেন। সবার ভাগ্যে জুটেছে একই অবস্থা।
মুজিবনগর উপজেলার পুরন্দরপুর গ্রামের বাহাদুর আলী বলেন, আমি গাংনী উপজেলার কাজীপুর গ্রামের আদম ব্যবসায়ী নাড়া মেম্বারের মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া এসেছি। আমরা প্রায় চার মাস এই ক্যাম্পে আটকা পড়ে আছি। এখানে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয় না। না খেয়ে মরে যাবো আমরা। আবার বাড়িতেও ঋণের কিস্তি। কথা বললে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এভাবেই চার মাস যাবত দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। প্রশাসনের কাছে আবেদন করি আমাদের এখানে থেকে উদ্ধার করেন।
শুধু তুহিন, বাহাদুর, আনারুল, জমিরুল বা লালচাদ ইসলাম নন, ওই ক্যাম্পে আটকা পড়ে আছেন প্রায় চার শতাধিক যুবক।
মালয়েশিয়াতে আটকে থাকা একাধিক ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কেউ দিয়েছেন জমি বন্ধক, কেউ সুদের ওপরে টাকা নিয়ে, কেউ বা তুলেছেন ঋণের কিস্তি। এখন যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, তারা বাড়িতে এসে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছেন।
কাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফারুক আহমেদ বলেন, আমার এলাকার অনেক যুবক দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। সব হারিয়ে তিন মাস যাবত কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। আমরা তাদের পরিবারের পাশে আছি।
অবশ্য দালাল চক্রের সদস্য হিসেবে পরিচিত সাহেবনগর গ্রামের বাবলু বলেন, আমি চার জনের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়ে মুছা এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছি। ৩/৪ মাস হলেও আমার লোকজনকে কোনো কাজ দেয়নি এজেন্সি। আজকে আমি তাদের জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছি।
গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রীতম সাহা বলেন, বিষয়টি প্রথম জানলাম। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা থানায় অথবা আমাদের কাছে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মেহেরপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম নাজমুল হক বলেন, আমরা প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছি। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মেহেরপুর জেলা প্রশাসক শামীম হাসান বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক থেকে বিষয়টি জানতে পেরেছি, পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। তাদের মামলা দায়ের করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৪
এসএম