ঠাকুরগাঁও: রাজধানী ঢাকার একটি বাড়িতে বন্দি থেকে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন গৃহকর্মী রেখা আক্তার। অবশেষে বন্দি জীবন থেকে পালিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরেছেন তিনি।
গত শনিবার (২৬ জুন) মধ্যরাতে নিজ বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের শীবগঞ্জ বাজার এলাকায় ফিরেছেন তিনি।
সাংবাদিকদের রেখা জানিয়েছেন, তার বয়স যখন ১৩ বছর তখন স্থানীয় ব্যবসায়ী ঢাকার বাসিন্দা মহসিন আলী তাকে ঢাকার ভাড়া বাসায় গৃহ পরিচারিকার কাজের জন্য নিয়ে যান। সেখানে তিনি এক বছর কাজ করেন। এ সময় প্রায় মহসিনের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী রুনা আক্তার ও তার আত্মীয় লোটাস তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। নিজের বাড়িতে ফিরতে চাইলেও যেতে দিতেন না। নির্যাতন সইতে না পেরে কোনো এক সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন রেখা।
রেখা আরও জানান, এ সময় কোনো এক মহিলার কাছে কাজের সন্ধান চাইলে তাকে একটি বাড়িতে নিয়ে যান এবং তিনি সেই বাড়িতে কাজ শুরু করেন।
তিনি তখনও জানতেন না এ বাড়িতে তার জন্য অপেক্ষা করছে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি। কাজে যোগ দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে তিনি বাসায় ফিরতে চাইলে তাকে ফিরতে দেওয়া হয়নি। বরং বাড়ির কথা মুখে নিলেই ঘরের আসবাবপত্র, লোহার রড, কাঠ দিয়ে অমানবিক নির্যাতন শুরু হতো। যেসব আঘাতের চিহ্ন এখনও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন রেখা।
রেখা বলেন, আমাকে বন্দি করে রাখা হতো। বাসার ময়লা ফেলতে গেলেও বাড়ির লোকজন আমাকে পাহারা দিতেন, যাতে আমি পালাতে না পারি। ভাবলেই বুক কাঁপে আমার। তারা আমাকে বাড়িতে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে দেয়নি। আমাকে তালা দিয়ে রাখা হতো।
ঢাকার কোন এলাকায় ছিলেন জানতে চাইলে রেখা বলেন, আমি লেখাপড়া জানি না। শুধু জানি ঢাকা যাওয়ার প্রথম দিকে ভূতের গলি নামের একটি জায়গার আশপাশে ছিলাম। পরে যে বাসায় কাজ নিয়েছিলাম, তার কোনো কিছুই আমি জানি না। ওই বাড়িতে ঢোকার পর আর বের হওয়ার বা কোনো মানুষের সঙ্গে মেলামেশারও সুযোগ দেননি তারা। সারাক্ষণ ঘরবন্দি করে রাখতো আর বাড়ির কথা মুখে নিলেই মারধর করতো। কষ্টের বিষয় এই ১৩ বছরে আমাকে কাজের কোনো মজুরি দেননি তারা। এটুকু জানি সেই বাড়ির মালিকের নাম মাহাবুব হোসেন ও তার স্ত্রীর নাম ঝর্ণা আক্তার।
অবশেষে কিভাবে পালিয়ে এলেন জানতে চাইলে রেখা বলেন, সেদিন বাসার শোকেসের ওপর চাবি রাখা ছিল। আমি চাবি দিয়ে বাড়ির সদর দরজা খুলে পালিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলাম। এরপর এক বয়স্ক লোক আমার ঘটনা শুনেছেন। তিনি আমাকে ৬০০ টাকা সাহায্য তুলে দিয়ে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে সহযোগিতা করেন। তারপর বাসের কন্টাক্টর আমাকে ঠাকুরগাঁও পৌঁছে দেন।
বাড়ি ফিরে কেমন লাগছে জানতে চাওয়া মাত্রই নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি রেখা। অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, বাড়ি ফিরে জানতে পারলাম আমার বাবা ও চাচা আর পৃথিবীতে নেই। দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। বাড়ি ফেরার মধ্যে আনন্দ কাজ করলেও বাবা হারানোর কষ্ট আমাকে তাড়া করছে। শত নির্যাতনের পরও আমাকে যদি তারা বাড়িতে যোগাযোগ করার সুযোগ দিতেন তাহলে অন্তত বাবা-মায়ের খবরটা জানতে পারতাম।
রেখার পরিবারে মাসহ আরও দুই বোন ও এক ভাই আছেন। তাদের মধ্যে রেখা সবার বড়। রেখার ছোট ভাই লিটন আলী ও ছোট বোন জানান, আমরা শুধু জানতাম আমাদের বড় এক বোন আছে। যিনি ঢাকায় কাজ করতে গিয়ে আর ফিরেননি। তিনি বাড়ি ফিরে এলে আমরা তাকে প্রথম দেখেছি। বোনের ফিরে আসাতে আমরা অনেক আনন্দিত।
রেখা ফিরে আসাতে খুশী প্রতিবেশীরাও। তার ফিরে আসার খবর শুনে তাকে দেখতে বাড়িতে ভিড় করছেন স্থানীয়রা।
এদিকে, রেখার মা আনোয়ারা বেগম মেয়ের ওপর এমন অমানবিক নির্যাতন ও বাসায় বন্দি রেখে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের দায়ে দোষীদের শাস্তি দাবি করেছেন। তিনি বলেন, যারা আমার মেয়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে দীর্ঘ এক যুগ গৃহবন্দি রেখে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেননি, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে যেন শাস্তি দেওয়া হয়। আর যেন কোনো মায়ের সন্তানের সঙ্গে এমন না হয়।
এ বিষয়ে রেখাকে প্রথম ঢাকায় নিয়ে যাওয়া মহসিন আলীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ২০১১ সালে আমার স্ত্রী গর্ভবতী থাকার কারণে ঘরের কাজের সহযোগিতার জন্য রেখাকে গ্রাম থেকে এনেছিলাম। সে কাউকে কিছু না বলে বছর খানেক পর বাড়ি থেকে মালপত্র চুরি করে চলে যায়। এ ঘটনায় রেখার পরিবার আমাদের নামে অপহরণ মামলাও করেছিল। আদালত আমাদের খালাস দিয়েছে। এ ঘটনায় স্থানীয়ভাবে তৎকালীন চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে তার পরিবারের সঙ্গে আমরা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমাধানও করেছি।
তবে রেখা চুরির অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং বলেন, শুধু মহসীন আলীর নির্যাতনের কারণে তিনি ঘর ছেড়েছিলেন।
জামালপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, শুনেছি মেয়েটি বাসায় ফিরে এসেছে। এর আগে তাকে একজনের বাসায় কাজে দেওয়া হয়েছিল। তার বাসা থেকে পালিয়ে যায়। তখন থানায় মামলা করা হয়েছিল। পরে এটা মীমাংসা করা হয়।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. বেলায়াত হোসেন বলেন, পরিবারটি যদি আইনি সহায়তা চায়, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে আইনি সহায়তা করা হবে। এর জন্য কোনো টাকা খরচ হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৩ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২৪
এসআইএ