সিলেট: সিলেটের গোলাপগঞ্জে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬ জনে দাঁড়িয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত শতাধিক।
রোববার (৪ আগস্ট) বেলা ২টার দিকে গোলাপগঞ্জ পৌর এলাকার ধারাবহরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে এ সংঘর্ষ ঘটে।
নিহতরা হলেন- উপজেলার বারকোট গ্রামের মৃত মকবুল আলীর ছেলে ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার তাজ উদ্দিন (৪৩), ঢাকাদক্ষিণ বাজারের ব্যবসায়ী ও নিশ্চিন্ত গ্রামের বাসিন্দা কয়ছর আহমদের ছেলে নজমুল ইসলাম (২৪) ও আমুড়া ইউনয়নের শিলঘাটের বাসিন্দা মৃত কয়ছর আহমদের ছেলে সানি আহমদ (২১), গোলাপগঞ্জ পৌর শহরের ঘোষগাওয় এলাকার মুরারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন (২৯), ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের বায়গড় লেছুবাগান গ্রামের মৃত ছুরাই মিয়ার ছেলে হাসান আহমদ (১৮) ও দত্তরাইল বাসাবাড়ি এলাকার আলাই মিয়ার ছেলে মিনহাজ আহমদ (২৩)।
সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সদস্যরা নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এরমধ্যে গৌছউদ্দিন ও মিনহাজের মরদেহ ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ইউএইচও) ডা. সুদর্শন সেন বলেন, নিহতদের মধ্যে তাজ ও নজমুলের মরদেহ হাসপাতালে রয়েছে। লোকজন বলাবলি করছিল আরো চারজন মারা গেছেন। তাদের মরদেহ আমরা পাইনি।
এছাড়া সংঘর্ষে আরো ২৫/৩০ জন আহত হয়েছেন। তাদের সাময়িক চিকিৎসা দিয়ে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে, বলেও জানান এই চিকিৎসক।
এদিকে, সানি আহমদের মৃত্যুর বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন গোলাপগঞ্জ উপজেলার আমুড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল গফফার। নিহতদের মধ্যে তাজ উদ্দিনের লাশ নিয়ে পৌরশহরে এসে ধারাবহর এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, দুপুরে গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণ ডিগ্রি কলেজের সামনে থেকে ছাত্র-জনতা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে উপজেলার ধারাবহর এলাকা পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে ছাত্র-জনতার তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। বিভিন্ন মসজিদে ঘোষণা দিয়ে এসময় এলাকাবাসীও সংঘর্ষে জড়িত হন।
প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে ছাত্র-জনতা ও এলাকাবাসী পুলিশ-বিজির দিকে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে এবং পুলিশ-বিজিবি গুলি, টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ ও বিজিবি পিছু হটতে বাধ্য হয়। সংঘর্ষ গোলাপগঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
বেলা ২টার দিকে পৌর এলাকার ধারাবহরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে কিছু মানুষ জড়ো হলে সেখানে পুলিশ ও বিজিবি উপস্থিত হয়। এতে জনতার মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে তাজ উদ্দিন ও সানি আহমদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সিলেট জেলার সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মো. সম্রাট তালুকদার সংঘর্ষের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ওই এলাকায় পরিস্থিতি খুবই থমথমে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টায় রয়েছে। যে কারণে হতাহতের কোনো খবর এখনো পাইনি।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ইউএইচও) ডা. সুদর্শন সেন বলেন, নিহতদের মধ্যে তাজ ও নজমুলের মরদেহ হাসপাতালে রয়েছে। সংঘর্ষে অন্তত শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। তাদের সাময়িক চিকিৎসা দিয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এবিষয়ে গোলাপগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাকছুদুল আমিনকে মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এরআগে সকাল ১১টার দিকে কোর্ট পয়েন্টে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর বেলা দেড়টার দিকে আওয়ামী লীগ মিছিল বের করে। এছাড়া জিন্দাবাজার ও চৌহাট্টা পয়েন্টে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে অনেকে হতাহত হয়েছেন। তবে কতজন আহতদের সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সরকার পতনের একদফা দাবিতে রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি পালনে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সড়কে নেমেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। দুপুরে নগরের কোর্ট পয়েন্টে পুলিশ-আন্দোলনকারী পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে মহানগরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারীদের ইটপাটকেলের জবাবে পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে।
বেলা ১টা থেকে জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, বারুতখানা, জেলরোড, হাওয়াপাড়া, মিরবক্সটুলা, নয়াসড়ক ও আম্বরখানাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেয়। সড়ক ব্যারিকেড দিয়ে তারা যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পক্ষান্তরে নগরের প্রতিটি পয়েন্টে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের মোকাবেলা করতে সশস্ত্র অবস্থানে রয়েছে।
রোববার (০৪ আগস্ট) বিকেল ৪টার দিকে সিলেট নগরের উপশহর শাহজালাল ব্রিজ সংলগ্ন আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এসময় আঞ্চলিক নির্বাচনী কর্মকর্তার গাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়। আতঙ্কিত হয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পার্শ্ববর্তী গার্ডেন টাওয়ারে গিয়ে আশ্রয় নেন।
সিলেট আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা মিনহাজ উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অবশ্য এই ঘটনায় তাদের কেউ হতাহত হননি। প্রাণভয়ে পার্শ্ববর্তী বহুতল ভবন গার্ডেন টাওয়ারে আশ্রয় নেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বিকাল ৪টার দিকে অন্তত অর্ধশতাধিক লোকজন নির্বাচন অফিসে হামলা ও ভাঙচুর করে। এরপরে হামলাকারীরা আয়কর অফিসে ভাঙচুর করে। এরআগে বিকাল সাড়ে ৩টায় দক্ষিণ সুরমায় সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমানের অফিস ও ১১টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এরপর বিকাল ৫টার দিকে নাইওরপুল এলাকা ব্লক করে রাখেন ছাত্রজনতা। তারা নাইওরপুল থেকে পূর্ব মিরাবাজার পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখে। এসময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে সিলেট মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখসহ পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। আহতরা ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্প সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এদিকে, সন্ধ্যার দিকে, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নগরের কুমারপাড়া মসজিদের সামনে মুসল্লিদের মারধর করে। এতে অন্তত ৮ জন আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০২৪
এনইউ/এমজে/এসএএইচ