ঢাকা, রবিবার, ২৫ কার্তিক ১৪৩১, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ক্যাসিনো খেলে কোটিপতি শওকত পরিবার, সর্বস্বান্ত এলাকার যুবকেরা 

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০২৪
ক্যাসিনো খেলে কোটিপতি শওকত পরিবার, সর্বস্বান্ত এলাকার যুবকেরা  শওকত গাজী, মোতালেব গাজী ও মো. কামাল মিজি ওরফে বাবু (বাঁ থেকে)

চাঁদপুর: চাঁদপুর সদর উপজেলার আশিকাটি ইউনিয়নের রালদিয়া গ্রামের বাসিন্দা শওকত গাজী। সেলাইয়ের কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাতেন।

পরিবার-পরিজন নিয়ে অভাব-অনটনেই চলছিল তার জীবন। তবে তার ভাগ্য ফেরায় অনলাইন ক্যাসিনো।  

রীতিমতো বড় মাপের জুয়াড়িতে পরিণত হন তিনি। নিজের সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এই জুয়া খেলায় নিয়ে আসেন।  

লোভনীয় অফার দিয়ে এলাকায় জুয়ার ফাঁদে লোকজন ভিড়িয়ে এখন তিনি কোটিপতি। তার ভাগ্য ফিরলেও এই জুয়া খেলায় মেতে এখন স্থানীয় অনেক যুবক সর্বস্বান্ত।  

গ্লোরি ক্যাসিনো নামে এক অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্মের নিয়মিত খেলোয়াড় শওকত গাজী।  

এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জুয়ার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হওয়া ৪ জন ভুক্তভোগী যুবকের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।  

তারা এখন জুয়ায় জড়িত না থাকলেও বিপুল অর্থ হারিয়ে দিশেহারা। পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে পারছেন না তাদের এই করুণ পরিণতির কথা।

এ বিষয়ে অনলাইন ক্যাসিনো জুয়াড়ি শওকত গাজীর সঙ্গে কথা বলতে তার বাড়িতে যান বাংলানিউজ২৪ -এর প্রতিনিধি। রালদিয়া গ্রামের বৈদ্যগ বাড়ি নামে পরিচিত শওকতের বাসভবনে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।

পরে শওকতের প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হয়।

শওকত গাজীর অর্থ-সম্পদ এলাকার সবার চাইতে বেশি এবং তিনি অনলাইন ক্যাসিনোতে জড়িত - এমন তথ্য দিলেন বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। তবে তারা নাম প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন।

তারা জানান, শওকত আলী গাজীর গত পাঁচ বছরে ঢাকায় বাড়ি হয়েছে এবং এলাকায় তিনি বেশ কয়েক একর জমি কিনেছেন। কেউ জমি বিক্রি করলেই তিনি কিনে নেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী জামাল প্রধানিয়া বলেন, শওকত গাজী ঢাকা মিরপুরে দর্জির কাজ করতেন। গত ৫ বছর আগে আমার দোকানে চাল বাকি নিয়ে টাকা দিতে পারেননি শওকত। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় জড়িয়ে দ্রুত সময়ে কোটি টাকার মালিক তিনি। এলাকায় কোটিপতি আর শিল্পপতি বলে তার পরিচয়।

স্থানীয় বাসিন্দা ও দক্ষিণ রালদিয়া জামে মসজিদের একাধিক মুসল্লির অভিযোগ, শওকত গাজীর অনেক টাকা। যে কারণে তার পক্ষে অনেক লোক কথা বলে। পাঁচ বছর আগে আমাদের দক্ষিণ রালদিয়া ও হোসেনপুর জামে মসজিদে বিদেশি সংস্থার অর্থায়ন করা হবে বলে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঘুষের জন্য নেন শওকত। কিন্তু সেই টাকা এখনো ফেরত দেননি তিনি। তার এই ধরনের কাজের বিষয়ে সবচাইতে ভালো জানেন মসজিদের উপদেষ্টা ওমর মাল।

মসজিদ কমিটির উপদেষ্টা ওমর মাল বলেন, শওকত গাজীর সঙ্গে গত ৩০ আগস্ট কথা হয়েছে। তিনি ওই ঘুষের টাকা ফেরত দেবেন বলে জানিয়েছেন।

শওকত গাজীর অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায় রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার গল্প জানতে গিয়ে বেরিয়ে আসা নানা তথ্য।  

তার এই জুয়ার ব্যবসা পরিচালনা করছেন বড় ছেলে মোতালেব গাজী এবং সহযোগী ছোট ছেলে মিরাজ গাজী। মোতালেব জুয়ার প্রধান কার্যালয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে আসা-যাওয়া করেন। জুয়ার অনলাইন ও স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হোয়াট্সঅ্যাপের অ্যাডমিন মোতালেব। আর স্থানীয়ভাবে লোকদের ক্যাসিনোর ফাঁদে ফেলে যুক্ত করান শওকত আলীর মেয়ের জামাতা মো. কামাল মিজি ওরফে বাবু।

ক্যাসিনোতে জড়িত যুবকদের মধ্যে শান্ত নামের একজন বলেন, আমি অনলাইনে এই জুয়ার সন্ধান পাই। তারপর ১২৫ শতাংশ বোনাসসহ নানা অফারে এতে জড়িয়ে পড়ি। কিন্তু এই খেলার মধ্যে বিকাশসহ বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা দেওয়ার পর যোগাযোগকারী ব্যক্তির নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তারা অনেক মোবাইলফোন নম্বর ব্যবহার করে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সদস্য ছিল প্রায় দেড় শতাধিক।

চাঁদপুর শহরের বাবুরহাট এলাকার ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত যুবকদের মধ্যে মানিক, শামীম ও রওশন বলেন, আমরা সবাই একই এলাকার বাসিন্দা। সবাই এই ক্যাসিনো খেলার ফাঁদে পড়েছি। আর কামাল নামে ব্যক্তিই হচ্ছেন এই জুয়ার স্থানীয় দালাল।

ওই এলাকার প্রবাসী নজরুল ইসলাম (সুমন) বলেন, আমি প্রবাসে থাকলেও দেশে নানান সামাজিক কাজ করে থাকি। সেই সুবাদে শওকত গাজীর মেয়ের জামাতা কামাল মিজির সঙ্গে পরিচয়। তিনি আমার কাছে ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হবে বলে ২০ লাখ টাকা নেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ফেরত দেননি। তার শ্বশুর ও পরিবার এলাকায় ক্যাসিনো জুয়ারি হিসেবে পরিচিত এবং মসজিদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন তার শ্বশুর। রাতারাতি এই পরিবার কোটিপতি হওয়ার বিষয়টি দুদক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

এই বিষয়ে বক্তব্যের জন্য জুয়ার অ্যাডমিন মোতালেব গাজীকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি। যে কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মোতালেবের বোন জামাতা কামাল মিজি বলেন, অনলাইনে ক্যাসিনো এটা কি আমি জানি না। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ সত্য নয়। আমি কোনো জুয়ার সঙ্গে জড়িত না। আপনার সঙ্গে আমি পরে কথা বলব।  

এই বলে ফোন কেটে দেন কামাল মিজি। পরে আর ফোন করেননি তিনি।

এদিকে বাড়িতে গিয়ে না পাওয়া গেলেও পরে কথা হয় প্রধান অভিযুক্ত শওকত গাজীর সঙ্গে। তার বক্তব্য একেক সময় একেক রকম। প্রথমে তিনি কোনোরকম ক্যাসিনোতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তিনি আল্লাহর কসমসহ নানা কসম দিয়ে কথা শুরু করেন।

শওকত গাজী বলেন, আমি এক সময় দর্জির কাজ করতাম। এখন আমাদের দুবাইতে ব্যবসা আছে। ব্যবসার কাজে আমার ছেলেকে বার বার দুবাইতে যেতে হয়।  

তবে দুবাইতে কীসের ব্যবসা প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।

ক্যাসিনো ও হুন্ডির ব্যবসা পরিচালনার জন্য আপনার ছেলে দুবাই আসা যাওয়া করে-এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন। আবার বলেন, আমার ছেলে ঢাকা গাজীপুরে নগদের ব্যবসা করে।

স্থানীয়দের অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে শওকত গাজী বলেন, আমি মসজিদের টাকা আত্মসাৎ করিনি। বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে বরাদ্দ এনে দেব বলে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়েছি সত্য। কিন্তু ঘুষের টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। যার মাধ্যমে ওই টাকা দিয়েছি সে টাকা দেয়নি। তারপরেও আমি বলছি আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেতে। মসজিদ নির্মাণের জন্য ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি সঠিক হয়নি বলে তিনি স্বীকার করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০২৪
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।