ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শিবচরের পদ্মায় অবৈধ ড্রেজারের ছড়াছড়ি

ইমতিয়াজ আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৪
শিবচরের পদ্মায় অবৈধ ড্রেজারের ছড়াছড়ি ফাইল ছবি

মাদারীপুর: প্রমত্তা পদ্মা নদীর তলদেশ খনন করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন থেমে নেই। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী, চরচান্দ্র এলাকার কাওলিপাড়াসহ পদ্মা সেতুর দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যেই দিন-রাত চলছে বালু উত্তোলন।

এছাড়া কাঁঠালবাড়ী, চরজানাজাত ইউনিয়নের পদ্মার চর এলাকার নদীবর্তী চর কেটেও মাটি নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে।  

অন্যদিকে, পদ্মা নদীর মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং ও শিবচর সীমান্ত এলাকাতেও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল এই বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত বলে একাধিক সূত্রে জানায়।

জানা গেছে, বর্তমানে অর্ধশত ড্রেজার বালু উত্তোলনের কাজে সক্রিয় রয়েছে। পদ্মা সেতুর কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের কাউলিপাড়া এলাকার নদীর বিভিন্ন স্থানে ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। ড্রেজার দ্বারা উত্তোলনকৃত বালু বাল্কহেডে ভরে নিয়ে যাওয়া হয় বিক্রির উদ্দেশে। প্রতি ঘনফুট বালু পাইকারি বিক্রি করা হয় ৮০-৯০ পয়সা দরে। আর খননের জন্য ড্রেজার মালিক প্রতি ঘনফুটে পান ৬০ পয়সা। খুচরা বাজারে এই বালু বিক্রি হয় প্রতি ঘনফুট ১০-১২ টাকা দরে! এই বালুই যেন সাদা সোনা!

ড্রেজারগুলো নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাড়ায় এনে নদীতে বালু উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন সময় অভিযানে শ্রমিকেরা আটক হলেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকেন বালু বিক্রয়ের মূল হোতারা ও ড্রেজার মালিক!

এদিকে বিভিন্ন সময়ে পদ্মা নদীতে অভিযান চালিয়ে ড্রেজার জব্দ, জড়িতদের আটক ও জরিমানা করা হলেও থেমে নেই অবৈধভাবে বালু উত্তোলন।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড্রেজার দিয়ে উত্তোলনকৃত বালু বাল্কহেড দিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে খুচরা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয় এসব বালু। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয় পদ্মার এই বালু ও মাটি।  

শিবচর উপজেলার চরজানাজাত নৌপুলিশ ফাঁড়ির আওতাভুক্ত থাকলেও নামে মাত্র মাঝে মধ্যে অভিযানের খবর পাওয়া যায়। নৌপুলিশের নাকের ডগায় পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন আর নৌপুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ জনসাধারণের কাছে।  

অভিযোগ রয়েছে, ‘অর্থনৈতিক সুবিধা’ প্রাপ্তির বিষয়টি এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও প্রশাসনের ‘অভিযান হবে’ এমন খবরও অদৃশ্যভাবে বালু উত্তোলনকারীর কানে পৌঁছে যায় আগেভাগেই! 

শিবচর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বালু উত্তোলনের খবর পেয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে গত বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে পদ্মা সেতু সংলগ্ন কাউলিপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় দুটি ড্রেজার জব্দ করে প্রশাসন। সেসময় দুজনকে আটক করা হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের এক লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মার তীরবর্তী এলাকার প্রভাবশালী কতিপয় ব্যক্তি পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত। রাতের বেলা এসব ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হতো। বর্তমানে দিনেও ড্রেজার চলে। প্রশাসনের তৎপরতা দেখলে সাময়িক বন্ধ রাখে ড্রেজার চালানো। বিশেষ করে পদ্মা নদীবর্তী এলাকার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এ কাজে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ব্যক্তি বিশেষের পরিবর্তন ঘটলেও নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের চাপে সাময়িক বন্ধ থাকলেও সুযোগ পেলেই শুরু হয় বালু উত্তোলন।

শিবচর ও লৌহজংয়ের কমপক্ষে অর্ধশত ড্রেজার বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।  

স্থানীয়দের দাবি নৌপুলিশের পাশাপাশি প্রশাসনের সঙ্গে কোস্টগার্ডের তৎপরতায় অভিযান হলে নিয়ন্ত্রণে আসবে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। দেদারসে বালু উত্তোলন হলে নদীর গতিপথেরও পরিবর্তন হতে পারে। হতে পারে ভাঙন তরান্বিতও!

কাঁঠালবাড়ী ও চরজানাজাত এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, ‘শিবচর উপজেলার চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের পদ্মা নদীতে জেগে ওঠা নতুন চরের (বাঘরা সীমানা, চার নং পোল এলাকা) মাটি ড্রেজারের মাধ্যমে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল কেটে বিক্রি করে দিয়েছে। নতুন জেগে ওঠা চর ফসল উৎপাদনের উপযোগী হলেও বালুখেকোদের কবলে পরে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, চরে চাষ করা ফসলসহ জমির মাটি কেটে বিক্রি করে থাকে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসকসহ (ডিসি) বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিলেও তেমন কোনো প্রতিকার হয়নি বলেও জানা গেছে। গত ৫ আগস্টের আগে নিয়মিত এসব এলাকার চরের মাটি কেটে নিতেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। বর্তমানে তারা পলাতক রয়েছেন।

ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক ব্যক্তি বলেন, ‘৩৩টি ড্রেজারের কাগজপত্র (অনুমতি) আছে বালু তোলার। তবে বালু বিক্রয়ের অনুমতি নেই। আমারও একটা ড্রেজার চলে। আমি ৩ লাখ টাকা দিয়ে কাগজ কিনেছি। ৩৩টার বাইরেও ড্রেজার চলে। তবে প্রশাসন অভিযান করলে অতিরিক্ত ড্রেজারগুলো কিছুদিন বন্ধ থাকে। তবে সুযোগ পেলেই সেগুলো আবার চলে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘ড্রেজার থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে বালু ফেলার নিয়ম থাকলেও বালু মূলত বাল্কহেড ভরে নিয়ে বিক্রি করা হয়। ’ 

তবে ‘অনুমতি কারা দেন বা কাগজপত্র কীসের’ এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।

এদিকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে শিবচরের চরজানাজাত নৌপুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুস সালাম বলেন, ‘গত তিন মাসে পদ্মা নদী থেকে ২৪টি বাল্কহেড ও ড্রেজার জব্দ করা হয়েছে। আমরা খবর পেলেই অভিযান পরিচালনা করি। তাছাড়া সাধারণ মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে ওরকম একটু বলেই। ’ 

শিবচরের চরজানাজাত নৌপুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিসুর রহমান বলেন, আমরা অভিযান চালাচ্ছি। গত কয়েক মাসে অনেক ড্রেজার আটক করেছি। পদ্মা নদীর মাগুরখন্ড, কাওলিপাড়া এলাকায় ড্রেজারগুলো চলে।  অনেকেরই ড্রেজার চালানোর কাগজপত্র রয়েছে।  

তবে পদ্মায় বালু উত্তোলনকারী সবগুলো ড্রেজারই অবৈধ বলে জানিয়েছেন শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল-মামুন।  

তিনি বলেন, আমরা প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করি। গত বুধবারও দুটি ড্রেজার জব্দ করা হয়েছে। ১ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। আমরা বালু উত্তোলন বন্ধে কঠোর অবস্থানে আছি। অভিযান অব্যাহত থাকবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৪
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।