ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মিশ্র পদ্ধতিতে নাইসগ্রিন লাউ চাষে ইলিয়াসের সফলতা

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪
মিশ্র পদ্ধতিতে নাইসগ্রিন লাউ চাষে ইলিয়াসের সফলতা

নাটোর: মাচায় ঝুলছে সারি সারি নাইসগ্রিন জাতের লাউ আর মাচার নিচে একই সঙ্গে চাষাবাদ হচ্ছে মুলা, পুঁইশাকসহ হরেক রকম সবজি ফসল। এসব সবজি সাধারণত শীতকালীন হলেও কৃষিতে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন ও কারিগরি সহায়তার কারণে এখন চাষাবাদ হচ্ছে সারা বছর জুড়ে।

ফলে সময়ের ফসল অসময়ে পেয়ে একদিকে যেমন বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। অপরদিকে সারা বছর পূরণ হচ্ছে মানুষের জন্য নিরাপদ সবজিরও চাহিদা।

মিশ্র পদ্ধতিতে একসঙ্গে লাউ, মুলা, পুঁইশাক ও বেগুনসহ হরেক রকম সবজি চাষাবাদ করে খুব সহজেই সফলতার মুখ দেখতে পারেন একজন কৃষক। তেমনি এক অভাবনীয় সাফল্যের পথে এগিয়ে চলেছেন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলা মির্জাপুর দিয়ার গ্রামের কৃষক মো. ইলিয়াস শেখ।  

তিনি একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তাও বটে। তার রয়েছে- নার্সারি, পলিনেট হাউজ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক বিহীন সবজির চারা উৎপাদন, বিপণন ব্যবস্থা। সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার চারা বিক্রি করে থাকেন তিনি। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া তিন বিঘা এবং লিজ বন্ধক সূত্রে তিন বিঘাসহ মোট ছয় বিঘা জমিতে কৃষি কাজ করে মাসে লাখ টাকা আয় করেন এ কৃষক। পড়ালেখা করে চাকরির আশা না করে কৃষিকেই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচসহ পরিবারের যাবতীয় খরচ যোগান মিটিয়ে তার বাড়তি আয় হয় খাত থেকে।

কৃষক মো. ইলিয়াস শেখ বাংলানিউজকে জানান, কৃষি বিভাগের কাছ প্রযুক্তিগত ও কারিগরি সহায়তা বা পরামর্শ নিয়ে ১২ কাঠা জমিতে গত প্রায় ৯০ দিন আগে তিনি মিশ্র পদ্ধতিতে এক সঙ্গে নাইসগ্রিন জাতের লাউয়ের চারা রোপণসহ মুলা ও পুঁইশাকের বীজ বপন করেন। এরপর ওই জমির ক্ষেতে মাচা তৈরি, পোকামাকড় থেকে ফসল রক্ষায় এবং কীটনাশকবিহীন ফসল উৎপাদনে জৈব বালাইনাশক ফাঁদসহ ১৪ থেকে ১৫টি আঠালো ফাঁদ, ছয়টি ফেরোমিন ফাঁদ তৈরি করে চাষাবাদকৃত এসব ফসলের নিবিড় পরিচর্যা করে তা বিক্রি উপযোগী করে তোলেন। জমি প্রস্তুত, বীজ, সার, মাচা, ফাঁদ তৈরি ও পরিচর্যাসহ তার এ পর্যন্ত চাষাবাদে খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। আর এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ হাজার টাকার ফসল বিক্রি করেছেন। এরমধ্যে ১২০০ পিচ লাউ ৩৬ হাজার টাকা, মুলা ছয় হাজার টাকা এবং পুঁইশাক তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি।

ইলিয়াস শেখ আরও বলেন, অন্তত ছয় মাস পর্যন্ত তিনি এ জাতের লাউ বিক্রি করবেন। ইতোমধ্যে ৩৬ হাজার টাকার লাউ বিক্রি করেছেন। মুলা বিক্রি শেষ পর্যায়ে আর পুঁইশাক আরও একমাস পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবেন। বর্তমানে লাউ ক্ষেতের চারপাশে মাচা পদ্ধতিতে টমেটোর চারা রোপণ করেছেন। ফলে এবার লাউয়ের সঙ্গে শীতকালীন টমেটোও বিক্রি করতে পারবেন তিনি। সবমিলিয়ে মিশ্র পদ্ধতিতে সবজি চাষ করলে কৃষকরা সব সময় লাভবান হবেন। কেননা একই জমিতে এক সঙ্গে একাধিক ফসল ফলানো সম্ভব, পাশাপাশি খরচও একই। কারণ আলাদা করে কৃষককে কোনো উৎপাদন খরচ করতে হয় না।

কৃষিতে তার উন্নয়ন ও সম্ভাবনার হাতছানি উল্লেখ করে ইলিয়াস শেখ বলেন, আমার একটি পলিনেট হাউজ আছে। সেখানে বর্তমানে লাউ, কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, টমেটো, পেঁপেসহ অন্তত ২৫ প্রকার ফসলের তিন লাখ চারা প্রস্তুত আছে। প্রতিদিন সেখান থেকে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার চারা বিক্রি করে থাকি। এছাড়া একটি নিজস্ব নার্সারি আছে সেখানে বিভিন্ন ধরনের ফুলের চারাসহ নানা ধরনের ফলজ ও বনজ চারা পাওয়া যায়। গত ১০ বছরে আমি ফসল চাষাবাদ, চারা উৎপাদন করে সফলতা অর্জন করে স্বাবলম্বী হয়েছি। আমার এমন সফলতা দেখে এখন অনেকেই পরামর্শ নিতে আসেন। মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করে ভবিষ্যতে চাষাবাদের পরিধি আরও বাড়াতে চাই।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, ইলিয়াস শেখ একজন কর্মঠ ও পরিশ্রমী কৃষক। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনি কৃষিতে সাফল্য পেয়েছেন। পাশাপাশি এলাকার কৃষকদের অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। তাই অনেক কৃষক তাকে অনুসরণ করেন। মাচায় অসময়ের তরমুজ চাষ, গ্রীষ্মকালী পেঁয়াজ, টমেটো চাষ এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বলে জানান তারা।

স্থানীয় বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান আলী বাংলানিউজকে জানান, কৃষক ইলিয়াস শেখ একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। তার সফলতা দেখে অনেকেই কৃষি কাজে এগিয়ে আসছেন। তিনি শুধু বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়নের মধ্যে নয়, পুরো নলডাঙ্গা উপজেলার মধ্যে একজন সফল চাষি। স্বল্প জমি ব্যবহার আর নতুন নতুন কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনি যে সফলতা অর্জন করেছেন, তা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস জানান, মিশ্র পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদ করলে জমির সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার হয়। এতে একই জমিতে এক সময়ের মধ্যে তিনটি ফসল ফলানো যায়। এ পদ্ধতিতে নলডাঙ্গা উপজেলায় অন্তত ১২০০ থেকে ১৩০০ জন কৃষক সবজি চাষাবাদ করছেন। বিশেষ করে বিপ্রবেলঘড়িয়া, ঠাকুরলক্ষ্মিকোল ও ব্রক্ষ্মপুর এলাকার কৃষকরা সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মিশ্র পদ্ধতিতে সবজি চাষাবাদ করছেন।

তিনি আরও বলেন, এক বিঘা জমি থেকে এক সঙ্গে যেন তিন বিঘার ফসল উৎপাদন করা যায়, সেজন্য মিশ্র পদ্ধতিতে জমিতে ফসল উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ, প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কেননা এতে করে একটি জমিতে ফসলের তীব্রতা বাড়ে ৩০০ ভাগ। সেই লক্ষ্য অর্জনে তারা কাজ করছেন। তবে বর্তমানে তার উপজেলায় ফসলের তীব্রতা ১৮৭ ভাগ। কারণ হালতিবিলে বছরে মাত্র একটি ফসল হয়। সেখানে ভাসমান সবজি চাষ করা গেলে ৩০০ ভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।

তিনি মিশ্র পদ্ধতিতে নাইসগ্রিন জাতের লাউ চাষ প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি অফিসার বলেন, এ জাতের লাউয়ের ফলন ও আকার ভালো হয়। অন্যান্য লাউয়ের তুলনায় খেতেও একটু বেশি সুস্বাদু। সারা বছর এ জাতের লাউ চাষ করা যায়। তবে এই জাতটিও হাইব্রিড। চলতি মৌসুমে নলডাঙ্গা উপজেলায় ৩০ হেক্টর জমিতে নাইসগ্রিন জাতসহ বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের লাউ চাষ হয়েছে। যার গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ২৮ থেকে ৩০ মেট্রিক টন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।