ঢাকা, রবিবার, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

৯ দফার পেছনের গল্প জানালেন সমন্বয়ক আব্দুল কাদের

ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪
৯ দফার পেছনের গল্প জানালেন সমন্বয়ক আব্দুল কাদের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ৯ দফা দাবির লিখন ও প্রচারের পেছনের ঘটনা প্রকাশ করলেন সমম্বয়ক আব্দুল কাদের।

রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি বলেছেন, কোটা সংস্কারকে উদ্দেশ্য করে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল; কিন্তু সরকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করলে আন্দোলন ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

তারই ধারাবাহিকতায় নয় দফার অবতারণা হয়।

আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিলাম; কিন্তু ১৬ তারিখ মঙ্গলবার আবু সাঈদসহ ৬ জন যখন শহীদ হয়, ঐদিন রাত ১২টায় সামনের সাড়ির সমন্বয়করা মিলে আমরা একটা অনলাইন মিটিং করি। মিটিংয়ে প্রথম এজেন্ডাই ছিল, আজকে যে ছয়জন শহীদ হলো, এই ছয় লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার কি না? তখন সবাই বলে ওঠে, ছয়টা লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার হতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা করা হয়। এই আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিসহ আরও কিছু দাবি দাওয়া উঠে আসে। বলে রাখা ভালো, আমরা এতোদিন ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পেশসহ নানান সফট এবং হার্ড কর্মসূচি নিয়ে মাঠে অবস্থান করেছিলাম; কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে একেবারে নির্বিকার-নির্লিপ্ত মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল।

আব্দুল কাদের বলেন, আলাপ-আলোচনার ধার ধারে নাই সরকার, কেবল হাইকোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বেগতিক হয়ে যায়, ৬ জন শহীদ হয়, ওই দিনই সরকার আলোচনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়। আমাদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দিতে থাকে আলোচনায় বসার জন্য। কিন্ত আমরা আলোচনার আহ্বানকে বারাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করি। যদিও ভিতর বাহির থেকে আলোচনায় বসার নানারকম চাপ আসছিল।

‘সরকার সংলাপের আহ্বান ফরমালি জানিয়েছিল। কিন্ত সেটার প্রেক্ষিতে আমরা আমাদের অবস্থান ফরমালি পরিষ্কার করি নাই। পরিষ্কার করার সুযোগও পাই নাই। বুধবার (১৭ জুলাই) গায়েবানা জানাজায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ আমাদের ওপর গুলি চালায়। আমিসহ কয়েকজন আহত হই। হান্নান মাসউদ গুলিবিদ্ধ হয়। তখন থেকেই আমরা আন্দোলন পরিচালনা করে যাবার স্বার্থে কৌশলী অবস্থান নিয়ে গ্রেপ্তার এড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। ’

তিনি বলেন, যদিও সরকারের সংলাপকে প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার রাতে আমরা কিছু দাবি দাওয়া ঠিক করেছিলাম কিন্তু পরবর্তীতে সবাই মিলে আলাপ-আলোচনা করে যে সেই দাবিগুলো ফাইনাল করব সে সময় পাইনি। তবে আমরা বৃহস্পতিবার (১৯ জুলাই) মাঠের কর্মসূচি (কমপ্লিট শাটডাউন) দিয়ে নিজেদের অবস্থান ক্লিয়ার করেছিলাম।

আব্দুল কাদের বলেন, বৃহস্পতিবার আমি আর আসিফ মাহমুদ ভাই এক বাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে চলে যাই। ওই দিন ১৮ তারিখ রাতেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। আমরাও কর্মসূচি চলমান রাখতে, গ্রেপ্তার এড়াতে বার বার জায়গা পরিবর্তন করে বেড়াচ্ছি। কারো সাথে তেমন কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না।

তিনি বলেন, আন্দোলনের শুরুতেই নাহিদ ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে এক লোকের সাথে সাক্ষাৎ করান এবং পরবর্তীতে আন্দোলনের উদ্দেশ্যে একাধিকবার ওই লোকের সাথে যোগাযোগ হয়; পরে জানতে পারি, তিনি শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক। কিন্তু তখনও শিবিরের সভাপতি এবং সেক্রেটারির সাথে ওইভাবে যোগাযোগ হয়নি।

শুক্রবার যাত্রাবাড়ী এলাকায় যখন আন্দোলন করছিলাম তখন শিবিরের ঢাবি শাখার সেক্রেটারি জেনারেল ফরহাদ ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বললেন—‘আন্দোলনরত কয়েকজন সমন্বয়ক সরকারের মন্ত্রীদের সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে, এতো এতো শহীদের রক্তের সাথে বেইমানি করছে তারা। আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। কিছু দাবি-দাওয়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, মানুষের সাথে বেইমানি করা যাবে না। ’

আব্দুল কাদের বলেন, আমি সম্মতি জানাই। আমাদের তো আগেই অবস্থান ছিল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। তাছাড়া মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাতের মিটিংয়ে ঠিক করা কিছু দাবি-দাওয়া আমার মাথায় আছে।

‘আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার মতো মাঠে কোনো সিনিয়র নেই। আসিফ-নাহিদ ভাইকে গুম করে রেখেছে। আমি সাত-পাঁচ না ভেবে ঝুঁকি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ওই দিন জুমার নামাজের পর পরই যাত্রাবাড়ীতে কয়কজন শহীদ হয়, সবগুলা আমার চোখের সামনেই ঘটছে। মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলছে, এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

‘তাছাড়া দীর্ঘদিন জেল-জুলুম, হামলা-মামলার শিকার হয়ে হাসিনার এমন অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছি; মাথা নত করি নাই। আমার পরিণতি কী হবে, সেটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করি নাই। চোখের সামনে মানুষ মেরে ফেলছে, মানুষের কথা চিন্তা করে নিজের জীবনের কথা ভাবার সময় পাই নাই। গত ৪/৫ বছর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই আমাদের দৃঢ়তা ধরে রাখার শিক্ষাই দিয়েছে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরার সিদ্ধান্ত নিই। ’

কিছুক্ষণ বাদে শিবিরের সেক্রেটারি আমাকে আবারও ফোন দিল। বলে, ‘কিছু দাবি-দাওয়া খসড়া আকারে করছি, তোমার সাথে আলোচনা করি’। আমাদেরও যেহেতু আগেই আলোচনা হয়েছিল অনেকগুলো দাবির ব্যাপারে সেগুলো তখন ওনার সাথে আলোচনা করে সমন্বিতভাবে তৈরি হয় ৯ দফা। ’

আব্দুল কাদের বলেন, তিনি একে একে কিছু দাবি বললেন। যেগুলা খুব কমন দাবি-দাওয়া যেমন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, ছাত্র হত্যার সাথে জড়িত পুলিশ প্রশাসনকে বরখাস্ত, সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা, উপাচার্যের পদত্যাগ। যেগুলা ৬ জন শহীদ হওয়ার পরে মঙ্গলবার রাতের বৈঠকের আলোচনাতেই আমরা ভেবেছিলাম। এছাড়া মানুষজনও সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছিল।

শেষের দিকে গিয়ে শিবিরের সেক্রেটারি একটা দাবি যুক্ত করল—‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে’। এটা আমি মানিনি, দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা হলো। পরে আমি বললাম, ‘ঢালাওভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা যাবে না, এক্ষেত্রে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলতে পারেন। ’ পরে সেটাই ঠিক হলো—‘লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে’।

এই হলো নয় দফা তৈরির পেছনের গল্প। তবে নয় দফা প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল শিবির। যেহেতু ইন্টারনেট নেই, গোলাগুলি-কারফিউর মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশরীরে পত্রিকা অফিসে গিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়েছে। বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।

আব্দুল কাদের আরও বলেন, আমাকে নতুন একটা সিম এবং মোবাইল সংগ্রহ করার পরামর্শ দিল তারা। আমি আমার শিক্ষার্থীর বাসা থেকে সিম নিয়ে ওই নম্বরটা নয় দফা সংবলিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির সাথে দিয়ে দিলাম। ওই দিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে ৪-৫ কিলো দূরে হেঁটে গিয়ে পরিচিত সাংবাদিকদের ফোন দিয়ে নয় দফার বিষয়টা জানালাম। টুকটাক ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদের সাথে আমার পরিচয় ছিল। তো ওই রাতে তাদের অনেককে একটা একটা করে দফা বাটন ফোন দিয়ে ম্যাসেজের মাধ্যমে দাবিগুলা লিখে পাঠিয়েছি।

পুরা নয়টা দাবি একসাথে ম্যাসেজে পাঠানো যায় না। কাউকে আবার মুখে বলে দিয়েছি। সে লিখে নিয়েছে। কেউ আবার রেকর্ড করে নিয়েছে। কনফার্ম হওয়ার জন্য অনেকেই ফোন দিয়েছে, এটা আসলেই আমি দিয়েছি কি না। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলাকেও ফোন দিয়ে কনফার্ম করতে হয়েছে। ‘আমার পক্ষ থেকে এটা যাচ্ছে, আপনাকে একজন পেনড্রাইভের মাধ্যমে পৌঁছে দিবে’। এইভাবে চলল রাতের ১১টা পর্যন্ত।  

তিনি বলেন, প্রতিদিন রাতের বেলায় বাসা থেকে দূরে চলে যেতাম। ফোন অন করে সাংবাদিকদের সাথে ২-৩ ঘণ্টা কথাবার্তা বলে, তাদের কনফার্ম করে, ফোন বন্ধ করে আবার বাসায় ফিরতাম। সিনিয়ররা গুম অবস্থায় ছিল, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না বাকিদের সাথেও। এইভাবেই চলতে থাকল। আমার বাসা ছিল যাত্রাবাড়ী থানার পাশেই। গ্রেপ্তারের আতঙ্ক, তারপরও বাসায় থাকতে হতো। শুরুতেই যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। কোনো রাত মসজিদে কাটিয়েছি। কোনো রাত অর্ধেকটা বাইরে কিংবা বাসার ছাদে কাটিয়ে শেষ রাতে বাসায় ফিরেছি।

বাংলাদেশ সময়: ২১২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪
এফএইচ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।