ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

অর্থের সংকট, ঘর মেরামতই বড় চ্যালেঞ্জ বন্যার্তদের

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০২৪
অর্থের সংকট, ঘর মেরামতই বড় চ্যালেঞ্জ বন্যার্তদের

লক্ষ্মীপুর: জেলার সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের পূর্ব দিঘলী গ্রামের বেড়িবাঁধের কূলে বসবাস করেন গৃহবধূ রানু বেগম। স্বামী প্রবাসী।

এক সন্তান এবং শাশুড়ি নিয়ে ছোট্ট টিনের তৈরি ঘরটিতে থাকতেন তিনি।  

দেড় মাস আগে তার ঘরে বন্যার পানি ওঠে। পানি যখন ঘরে খাটের কাছাকাছি চলে আসে, তখন আর ঘরে থাকা সম্ভব হয়নি রানুর। ছেলে এবং শাশুড়িকে নিয়ে বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন ঘরের অর্ধেকাংশ পানির নিচে তলিয়ে থাকায় বাঁশ বেড়া পচে গেছে।

এছাড়া ঘরের পাশে থাকা বড় একটি কড়ইগাছ পড়ে ঘরটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ঘরে থাকা খাটসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও ভেঙে গেছে। রানু বেগম এখন সে ঘর মেরামতের কাজ শুরু করেছেন। পুরো মেরামত করতে তার লাখ টাকার বেশি খরচ হবে। রানু হয়তো সে ব্যয়ভার বহন করার সামর্থ রাখেন। কিন্তু রানুর মতো ঘর মেরামত করার সামর্থ্য নেই ওই এলাকার বেশিরভাগ লোকজনের।  

সরেজমিনে গিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের বাসিন্দাদের হাহাকার লক্ষ্য করা গেছে। বহু লোকজনকে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে দেখা যায়।

রানুর এলাকার বাসিন্দা বিধবা জাহেদা বেগম। বন্যায় তার ঘরটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু জাহেদার সামর্থ্য নেই ঘরটি মেরামত করার। জরাজীর্ণ এ ঘরটি নিয়ে দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই তার। কীভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁইকে পুনরায় মেরামত করবেন, সে ভাবনায় যেন ঘুম নেই এ বিধবার।

জাহেদা বলেন, 'পেটে ভাত জুটাতে কষ্ট হয়, ঘর মেরামত করবো কি দিয়ে। স্বামী নেই, নিজেই গরু লালন পালন করি। দুধ বিক্রি করে সংসার চালাই কোনোমতে। বন্যা আসায় গরুর খাবার জোগাড় করতে পারি না, তাই দুধও দেয় না। এখন সংসারই চলে না। ভাঙা ঘর মেরামত করার টাকা পাব কই?

বেড়িবাঁধের পাশে বৃদ্ধ মোস্তফা এবং নুরজাহান দম্পতির বসবাস। ঝুপড়ি একটি ঘর ছিল, সেটিও বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন তারা। এখন পানি নামার পর ঘরে ঢুকেছেন। তাদের ঘরটির বেড়া দিয়েছেন সিমেন্টের বস্তা দিয়ে। আর ঘরের ওপরে টিনের চালা থাকলেও ফুটো দিয়ে পানি।

এ দম্পতি জানায়, আয় রোজগার নেই। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খুঁজে আহারের জোগান দিতে হয়। তাই ঘর মেরামতের কোনো ব্যবস্থা নেই।

লক্ষ্মীপুরে ভয়াবহ বন্যায় ৪০ হাজার ৮০১টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ঘরের বেশিরভাগই কাঁচাঘর। ঘর মেরামত নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় ঘরের বাসিন্দারা। দীর্ঘ সময় ধরে বন্যা থাকায় দুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের আয় রোজগার অনেকটা বন্ধ ছিল। এ সময় তাদের খাদ্যের জোগান দিতেই কষ্ট হয়েছে। এখন বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট ঘর মেরামত।

পশ্চিম দিঘলী গ্রামের কৃষক মমিন উল্যার বসতঘরটি বন্যার পানিতে তলিয়ে ছিল। এতে ঘরের খুঁটি ভেঙে ঘরটি জরাজীর্ণ হয়ে আছে। বন্যায় তিনিও অর্থ সংকটে পড়ে ঘর মেরামত নিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন।

মমিন উল্যা বাংলানিউজকে বলেন, বন্যায় ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রান্না ঘর এবং গোয়াল ঘরও জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। ঘরের ভিটির মাটি পানির তোড়ে ক্ষয়ে গেছে। ঘর মেরামত করতে দুই লাখ টাকার মতো লাগবে। আমি কৃষক। কৃষিকাজ করে সংসার চালাই। বন্যায় তো কৃষিও শেষ। এবার ঘর করবো কি দিয়ে? আয়-রোজগারও নেই। সংসারে খাবার জোগাতেই কষ্ট হয়।

ওই এলাকার সুরাইয়া বেগমের বাড়িতে এখনো বন্যার পানি। পানি ঘর থেকে নামলেও বাড়ির উঠোনে রয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় পানি থাকায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ঘরটি। মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে এখন রাজ্যের চিন্তা এই নারীর। কারণ তার সংসারই ঠিকমতো চলে না। প্রায় ২০ বছর আগে স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। এক সন্তানকে নিয়ে থাকেন তিনি। ঢাকায় একটি দোকানের কর্মচারী হিসেবে চাকরি করেন তার ছেলে।

সুরাইয়া বাংলানিউজকে বলেন, বন্যার পানি আমার ঘরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের পশ্চিম পাশের অংশ ভেঙে পড়ে। এতে ঘরটি কাত হয়ে যায়। পানিতে ঘরের মাটি সব চলে গেছে। মেরামতের কোনো ব্যবস্থা নেই। দুই লাখ টাকার মতো মেরামতে খরচ আসবে। কিন্তু টাকা জোগানোর কোনো শক্তি নাই৷ কি-যে কষ্টে আছি, বলে বুঝাতে পারবো না। অন্যের বাড়িতে আপাতত আশ্রয় নিয়ে থাকি। ঘরে থাকার পরিবেশ নাই।

পূর্ব দিঘলী গ্রামের মারজান বেগম বলেন, বন্যার শুরুতে পানি ঘরের সামনে ছিল। পরে ঘরে ঢুকে পড়ে। প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। বন্যার পর বাড়িতে এসে দেখি ঘরের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখন কোনো রকমে থাকি। রান্নাঘর ভেঙে গেছে। স্বামী অসুস্থ, হাত ভেঙে ঘরবন্দি। আয় রোজগার নেই। ঘর মেরামতের টাকাও নেই।

একই এলাকার বৃদ্ধা মোবাশ্বেরা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করতাম। বন্যার পানি উঠলে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠি। বন্যার পানিতে ঘরের বেড়া-খুঁটি ভেঙে ঘর একেবারে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। একটা বেড়াও নেই। এগুলো মেরামত করার মতো কোনো টাকা বা সাধ্য আমাদের নেই৷ পরিবারের আটজন সদস্য এ ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করি।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, বন্যায় জেলাতে কাঁচা ও পাকা ৪০ হাজার ৮০১টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৩৮৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারিভাবে সহায়তা আসতে পারে। বরাদ্দ সাপেক্ষে অধিক ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।