ঢাকা, রবিবার, ১১ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সিজিএসের সভায় আবদুল আউয়াল মিন্টু

যারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন তারাই নিগৃহীত

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২৪
যারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন তারাই নিগৃহীত

দেশে দুটি গোষ্ঠী। একটি বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও সম্পদ সৃষ্টি করেছে।

আরেক গোষ্ঠী কোনো কাজ না করেই সম্পদ অর্জন করেছে। দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে যারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন, তারাই নিগৃহীত ছিলেন। এখনো তারা একই অবস্থায় আছেন এমন মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু।  

তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা এমন সংস্কার চান, যাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সম্পদ সৃষ্টি হয়।

আর এই সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হলে এর জন্য ভালো রাজনীতি দরকার। গত ১০ বছরে যে সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে তা ওপরের দিকে গেছে, নিচের দিকে আসেনি।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সম্মেলনকক্ষে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে এসব কথা বলেন তিনি।

সভায় ব্যবসায়ীরা বলেন, দেড় যুগ ধরে মন্দা অবস্থায় দেশের অর্থনীতি।

বিপর্যস্ত ব্যবসার পরিবেশ এবং ভঙ্গুর আর্থিক খাতের প্রভাবে দেখা মেলেনি কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ। ফলে তৈরি হয়নি নতুন কর্মসংস্থান। এ সময় আমলাতন্ত্রের রাজনৈতিক আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা দাবি করেছেন, ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সংস্কার পদক্ষেপে জোর দিতে হবে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।

আলোচনায় বক্তারা বলেন, দেশের আর্থিক খাতের সংস্কারে বড় বাধা সঠিক নীতি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন। বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ সামলাতে এরই মধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।

তারা বলেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা যত দিন ঠিক না হবে তত দিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঠিক হবে না। এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দেওয়া সরকারের উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।

ব্যবসা ও বিনিয়োগের নানা দিক নিয়ে আলোচনার বিষয়ে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সব সমস্যা আলোচনা হলেও এখন বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধবে কে? এমন লোক দেখছি না। আলোচকদের মধ্যে এমন লোক নেই, এমনকি সরকারের মধ্যে এমন লোক দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, আন্দোলন ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। দেশে প্রতিবছর ২২ লাখ কর্মক্ষম লোক চাকরির বাজারে আসে। এর মধ্য থেকে মাত্র ৫ শতাংশ যায় সরকারি চাকরিতে। বাকি ২০ লাখ তরুণ কোথা থেকে চাকরি পাবে। সরকার পাঁচ শতাংশের বেশি আর চাকরি দিতে পারবে না। বাকিদের চাকরির একমাত্র পথ বিনিয়োগের মাধ্যমে। এগুলো যারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ করছেন তারাই করছেন। আর তারাই সমাজে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত আছেন। কারণ তাদের বলা হচ্ছে সিন্ডিকেট বা চোর।

আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বেকারদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে দরকার বিনিয়োগ। আর এই বিনিয়োগ পেতে দেশে যেটা দরকার সেটা হলো সামাজিক মূলধন। অনেকেই মনে করেন টাকা হলেই বিনিয়োগ করতে পারবেন। কিন্তু বিনিয়োগের মূল ভিত্তি সামাজিক মূলধন। এই মূলধন আসে একটি উদ্যোগ ও উদ্যোক্তার মাধ্যমে। দেশে যদি সঠিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পেতে চান, তাহলে প্রথমে দরকার সামাজিক শৃঙ্খলা। এখন নানা বিভক্তির কারণে সামাজিক মূলধন অনুপস্থিত। ফলে এখানে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। যারা বিনিয়োগ করছেন তারা মরবেন। বিনিয়োগকারীরা এখন চতুর্মুখী বিপদের সম্মুখীন।  

তিনি বলেন, সঞ্চয় না করলে বিনিয়োগ আসবে কোথা থেকে? বছরের পর বছর যখন মূল্যস্ফীতি মজুরি বৃদ্ধির ওপরে থাকে, সেখানে সঞ্চয় হবে কীভাবে? যার ফলে কয়েক বছর ধরে সঞ্চয় কমেছে। অন্যদিকে মজুরি বৃদ্ধির হারও কমেছে। এই দুটির ঘাটতি হলে বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগ করার পরে গ্যাস নেই। গ্যাস পেলে বিদ্যুৎ নেই। বহুমাত্রিক সমস্যা—এগুলো সমাধান করা জরুরি।

তিনি আরও বলেন, দেশে সবচেয়ে বেশি ভুল হয় যখন রাজনীতি ও অর্থনীতিকে আলাদা দেখি। এই দুটি সম্পূরক। রাজনীতি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, আর অর্থনীতি রাজনীতিকে পরিচালিত করে। যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা যদি চোর হন তাহলে কী বলা যাবে। যতই সংস্কারের কথা বলি এগুলো রাজনৈতিক ইস্যু। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক না হলে বিনিয়োগ, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নত শিক্ষা কিছুই হবে না। কোনো সংস্কারেই কোনো কাজ হবে না। গণতান্ত্রিক সরকার এলে অর্থনীতিসহ অন্যান্য সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।

মীর নাসির হোসেন বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা যদি ঠিক না করতে পারি, তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সেখানে দুর্বৃত্তায়নে পণ্যের মূল্য বাড়ছে। এটা যদি সমাধান করতে না পারি তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

‘সবাই সংস্কার নিয়ে কথা বলছি। আমরা উপরিকাঠামো নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু গরিব মানুষের কথা ভাবছি না’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

তিনি বলেন, ‘ভূমিহীন কৃষকের কী হবে, গার্মেন্টসকর্মীদের স্যালারি কত হবে—এসব নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। ’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, খাবারের যা প্রয়োজন তার বেশির ভাগ অংশই আসে আমদানির মাধ্যমে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমাবেন—এমন আশা করা অনুচিত।

বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, ‘উন্নয়ন নিয়ে যত কথা হয়, কর্মসংস্থান নিয়ে তত কথা হয় না। ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হচ্ছে না বিধায় আমরা আমাদের জায়গা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। ’

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, রাজনীতিবিদরা হয়ে গেছেন আমলাতান্ত্রিক আর আমলাতান্ত্রিকরা হয়ে উঠেছেন রাজনীতিবিদ। দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনকে ভাঙতে হবে।  

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, খোলাবাজারে যত্রতত্র বেচাকেনার জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করার জন্য আগে ব্যাংকের নীতিমালা নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। নীতিমালা প্রণয়নে ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলেই কোনো নীতিমালাই ফলপ্রসূ হয়নি।

ডিসিসিআই সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে তরুণদের শিক্ষা, কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণের জন্য ক্রেডিট কার্ড তৈরি করতে হবে। তরুণদের সামনে নিয়ে আসতে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। ’ 

ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সবুর খান বলেন, কথায় কথায় বলছি ঋণখেলাপি, যারা ঋণ নিচ্ছে তাদের ট্যাক্স ফাইল কেন দেখা হয় না? বাংলাদেশ ব্যাংকে কেন ক্রেডিট স্কোরের পরিচয় করানো হচ্ছে না? কারা কথা না বলে কাজ করতে পারে, তাদের আগে খুঁজে বের করে কাজ দেওয়া দরকার। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন।  

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ার মুনিরা খানের সভাপতিত্বে সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে অংশ নিয়েছেন বারভিডা সভাপতি আব্দুল হক, সেন্টার ফর নন-রেসিডেন্স বাংলাদেশির চেয়ারপারসন এম এস সেকিল চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২৪
আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।