ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

অব্যবস্থাপনা-সমন্বয়হীনতায় নিরসন হচ্ছে না গুলিস্তানের যানজট

সুব্রত চন্দ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০২৪
অব্যবস্থাপনা-সমন্বয়হীনতায় নিরসন হচ্ছে না গুলিস্তানের যানজট গুলিস্তানে যানজট লেগেই থাকে, ছবি: ডি এইচ বাদল

ঢাকা: অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও সমন্বয়হীনতায় নিরসন হচ্ছে না গুলিস্তান এলাকার যানজট। ফলে নগরীর শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে এই সমস্যার সমাধানে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সেটি কোনো কাজে আসছে না।

বছরের পর বছর ধরে যানজটে নাকাল হয়েই এই এলাকায় চলাচল করতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

গুলিস্তান এলাকায় যানজটের মূল কারণ হিসেবে ফুটপাত দখল, যত্রতত্র বাস থামানো, ফুটওভারব্রিজ না থাকা, আইন না মানার প্রবণতা, অধিক মানুষের আনাগোনা, প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর আইন প্রয়োগে শিথিলতা ও সমন্বয়হীনতাকে চিহ্নিত করেছেন ভুক্তভোগী ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা করে কাজ করলে এবং আইন প্রয়োগে কঠোর হলে গুলিস্তানের যানজট নিরসন সম্ভব। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো দায় চাপাচ্ছে একে অন্যের ওপর।

গুলিস্তান এলাকার যানজট নিরসন ও সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। দুই পক্ষই গুলিস্তানের যানজট নিরসনে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে। তবে এই ব্যর্থতার জন্য নিজেদের জনবল সংকট ও অপর পক্ষের ওপর দোষ চাপাচ্ছে উভয় সংস্থাই।

সরেজমিনে গুলিস্তান এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকা ঘিরে ব্যাংকপাড়া, সচিবালয়সহ সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য মার্কেট। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আসা-যাওয়ার একটি মূল কেন্দ্রও এই এলাকা। ফলে এই এলাকায় প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের আগমন ঘটে। বাড়ে যানবাহনের চাপও। বিশেষ করে সকালে আফিস শুরুর সময় ও বিকেলে অফিস শেষে এই এলাকা পার হতে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় নষ্ট করতে হয়। বাসচালক ও যাত্রীদের মতে, পল্টন থেকে ফুলবাড়িয়া বা বঙ্গভবন পর্যন্ত যেতে কখনো কখনো কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়।

যেসব কারণে যানজট
ভুক্তভোগী, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুলিস্তান এলাকায় যানজট সৃষ্টির প্রধান কারণ ভ্রাম্যমাণ হকারদের ফুটপাত দখল। সরেজমিনেও ঘুরে দেখা যায়, জিরো পয়েন্ট থেকে গোলাপশাহ মাজার হয়ে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত এবং জিরো পয়েন্ট থেকে স্টেডিয়াম মার্কেট হয়ে বঙ্গবন্ধু চত্বর পর্যন্ত প্রতিটি ফুটপাত হকারদের দখলে। শুধু ফুটপাত নয়, সড়কের এক তৃতীয়াংশও হকাররা দখল করে জামা-জুতা-ফল বিক্রি করছেন। ফলে একদিকে পথচারীরা যেমন ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসছেন, অন্যদিকে যান চলাচলের রাস্তাও সংকীর্ণ হয়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

হকারদের পাশাপাশি চালকরাও যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করছেন। এতে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে পেছনে গাড়ির দীর্ঘ সারি তৈরি হয়। এছাড়া লেগুনা, ঘোড়ার গাড়ি ও ঢাকার বাইরে থাকা আসা বাসের অবৈধ স্টপেজের কারণে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। গোলাপশাহ মাজার মোড়েই লাইন ধরে দাড়িয়ে যাত্রী তুলে সদরঘাট রুটে চলাচলকারী ঘোড়ার গাড়িগুলো। স্টেডিয়াম মার্কেটের সামনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয় স্বদেশ পরিবহন, বোরাক পরিবহন, দোলা, রূপান্তর, বিআরটিসি, দোয়েল, আশিয়ান, বন্ধন, মেঘালয়, উৎসব পরিবহন, চন্দ্রা পরিবহন, যাতায়াতসহ ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি পরিবহন। যার ফলে মূল রাস্তার একটি লেন সব সময় বন্ধই থাকে।

গুলিস্তানের ফুলবাড়ি মোড়ে শুধু বিআরটিসির একটি ছোট টার্মিনাল রয়েছে। তবে ইলিশ পরিবহন, আনন্দ, গাংচিল, প্রচেষ্টা, স্বাধীন, গোল্ডেন লাইন, হানিফ, ইমাদ, দোলা, টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসসহ ঢাকার বাইরে চলাচলকারী বেশ কয়েকটি পরিবহনের বাসগুলো সেখানে স্ট্যান্ড করে রাখতে দেখা যায়। ঢাকা বাইরের এসব বাস ঘোরাতেও গুলিস্তানের মতো জনাকীর্ণ রাস্তা ব্যবহার করা হয়। যার কারণে বাসের অধিক চাপে যানজটের সৃষ্টি হয়।

এ ছাড়া এই এলাকায় কোনো ফুটওভারব্রিজ না থাকায় সাধারণ পথচারীরা তাদের ব্যাগ-বস্তা নিয়ে যেখানে-সেখান দিয়ে রাস্তা পারাপার করেন। এতে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। নানা সময় ঘটে দুর্ঘটনাও। সেসব দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্বের পাশাপাশি প্রাণও হারান অনেকে।

ভুক্তোভোগীদের বক্তব্য
বিকল্প পরিবহনের চালক মনিরুল বাংলানিউজকে বলেন, যানজটের কারণে প্রতিদিন পল্টন, গুলিস্তান এলাকা পার হতেই ঘণ্টা পার হয়ে যায়। কখনো কখনো তিন ঘণ্টাও সময় লাগে। এই যানজটের মূল কারণ ফুটপাত। হকাররা ফুটপাত তো দখল করেছেই, সঙ্গে রাস্তাও। এ ছাড়া বিভিন্ন দিক থেকে এখানে গাড়ি আসায় এবং ঢাকার বাইরের বাসগুলো ইউটার্ন নেওয়ায় যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রশাসন এসব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এই এলাকার যানজট কমছে না। যাত্রী ওঠানামার জন্য আমাদের মোড়গুলোতে বাস দাঁড় করাতে হয়। এটা আমাদের ভুল। কিন্তু নির্ধারিত বাস স্টপে দাঁড়ালে যাত্রী পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে যাত্রীদেরও নিয়ম না মানার প্রবনতা রয়েছে।

প্রায় ২৫ বছর ধরে ভিক্টর পরিবহনের বাস চালাচ্ছেন আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, পল্টন থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত পার হতে এক-দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। যানজটে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয় দেখে যাত্রীরা বাস থেকে নেমে যান। ফুটপাত দখলের কারণেই মূলত যানজট হয়।

নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রুটে চলাচলকারী দোয়েল পরিবহনের সুপারভাইজার মো. বাদল বলেন, আমরা গাড়ি রাস্তায় রাখি ঠিক আছে, তবে আমরা রাস্তার এক পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াই। যাতে অন্য যানবাহন চলাচল করতে পারে। যদি প্রশাসন আমাদের দাঁড়ানোর জন্য টার্মিনাল বা অন্য কোনো ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে আমাদের রাস্তায় দাঁড়াতে হয় না।

বঙ্গবন্ধু চত্বর এলাকায় সড়কে শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনকারী কমিউনিটি পুলিশ মো. খোকন বলেন, গুলিস্তানে ঢাকার বাইরের অনেক বাস আসে। যে যার মতো বাস ইউটার্ন করে, দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলো। কোনো শৃঙ্খলা নেই। নতুন ট্রাফিক পুলিশকে হকার বা বাস চালকরা গুরুত্ব দেয় না। যে যার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। যে কারণে অফিস শুরু ও শেষের সময় এই এলাকার সড়কে ভয়াবহ যানজট দেখা দেয়।

গুলিস্তান এলাকায় প্রায় কাজে আসতে হয় বেসরকারি চাকরিজীবী রুম্মান হোসেনকে। তিনি বলেন, কোনো কাজে গুলিস্তান এলেই সেদিন আর অন্য কোনো জায়গায় যাওয়া যায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হয়। ফুটপাত দখলের কারণে হেঁটেও চলাচল করা মুশকিল হয়ে যায়। বাসগুলো যাত্রী নেওয়ার জন্য যেখানে সেখানে দাঁড়ায়। এতে একদিকে সময় নষ্ট হয়, অপর দিকে ভোগান্তিরও শেষ থাকে না আমাদের।

ট্রাফিক পুলিশের বক্তব্য
মতিঝিল ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট আজহার বলেন, গুলিস্তান এলাকার যানজটের প্রধান কারণ ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে হকাররা বসা। আমরা প্রতিদিনই অভিযান করে তাদের ফুটপাত ও রাস্তা উদ্ধার করি। কিন্তু তাদের দৌরাত্ম্য এত বেশি যে একদিক দিয়ে উঠিয়ে দিলে আবার তারা এসে বসে যায়। আমরা রাস্তার ওপর থাকা টং দোকান ভেঙে দেই, তারা আবার নতুন করে গড়ে তোলে। আমরা তাদের মালামাল জব্দ করে পুলিশকে দিয়ে দেই, তারা সেটা থানা থেকে আবার ছাড়িয়ে আনে। তাদের আটক করে দিলেও লাভ হয় না। কারণ তাদের যে অপরাধ, সেই অপরাধে শক্ত মামলা দেওয়া যায় না। যে কারণে তারা ছাড়া পেয়ে আবার এসে বসে। সিটি করপোরেশন যদি প্রতিদিন নিয়ম করে অভিযান চালায় এবং কাউকে ফুটপাত ও রাস্তায় বসতে না দেয়, তাহলে এই যানজট নিরসন সম্ভব। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেটা নিয়মিত করে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুলিস্তান এলাকার আরেক সার্জেন্ট বলেন, গোলাপশাহ মাজার ও ফুলবাড়িয়া এলাকায় যাত্রীবাহী বাসগুলো যত্র-তত্র দাঁড়িয়ে থাকে। যার কারণে সড়কে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে যানজট সৃষ্টি হয়। ফুটপাত দখলের কারণেও সড়কে যানজট হয়। সেটা দেখাশোনা করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। কিন্তু তারা বছরে দুই একবার ফুটপাত দখলমুক্ত করে নিজেদের দায় সারে। আমরা ট্রাফিক পুলিশ বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেও এই হকারদের সরাতে পারি না। কারণ এরা সংখ্যায় অনেক বেশি। ৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীও ফুটপাত দখলমুক্ত করেছিল। কিন্তু সেটা টেকসই হয়নি। দুইদিন পরই আবার দখল হয়ে গছে। যেখানে সেনাবাহিনীই হকারদের উচ্ছেদ করতে পারছে না, সেখানে ট্রাফিক পুলিশের আর ক্ষমতা কতটুকু?

তিনি আরও বলেন, গুলিস্তানে প্রতিদিন অসংখ্য চাকরিজীবী আসেন। অনেক ব্যবসায়ী আসেন। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে এখানে এসে নামেন। কিন্তু এই এলাকায় কোনো ফুটওভার ব্রিজ নেই। যার কারণে মানুষ গাড়ির সামনে দিয়েই ব্যাগ-বস্তা নিয়ে রাস্তা পার হয়। এতে গাড়ি চলাচল বিঘ্ন হয়ে যানজট হয়। এ ছাড়াও এখানে অবৈধ বাস ও লেগুনা স্ট্যান্ড রয়েছে। তারা সিটি করপোরেশনকে ম্যানেজ করে রাস্তা দখল করে নিজেদের গাড়ি রাখে। অথচ ঢাকার বাইরের বাসগুলোর এখানে আসারই অনুমতি নেই। আমরা নিয়মিত মামলা দেই। কিন্তু তারপরও কাজ হয় না। সিটি করপোরেশনকে এসব অবৈধ বাস ও লেগুনা স্ট্যান্ড উচ্ছেদে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই এই এলাকার যানজট নিরসন সম্ভব।

ট্রাফিকের মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি- অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আনোয়ার সাঈদ বলেন, এখানে মূল চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে, রাস্তা ও ফুটপাতে প্রচুর হকার। যে কারণে আমাদের যখন পিক আওয়ার থাকে, তখন গাড়ির ফ্লো স্লো হয়ে যায়। পিক আওয়ারে ফ্লাইওভার ও নিচের অংশ দিয়ে অনেক গাড়ি আসে। যে কারণে এই জায়গায় যানজট হয়। আমরা যানজট নিরসনের চেষ্টা করি। হকার উচ্ছেদের জন্য প্রতিদিন আমাদের ফোর্স আসে। প্রতিদিন আমরা ৩-৪ বার হকার উচ্ছেদ করি। আমাদের এই কার্যক্রম চলমান আছে। আমরা চেষ্টা করি, আইন প্রয়োগ করে হকার উচ্ছেদ করে এই জায়গাটা ইজি রাখার। কখনো পারি, আবার কখনো পারি না।

প্রতিদিন হকার উচ্ছেদের পরও কেন যানজট নিরসন হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, রাস্তা ও ফুটপাতের মালিকানা সিটি করপোরেশনের। আমাদের রাস্তায় ঝামেলা হয় দেখে আমরা হকার সরিয়ে দেই। কিন্তু আমাদের জনবল কম। ৫০০ হকার সরাতে গেলে আমাদের ৫০ জন লোক লাগে। এই ৫০ জন মানুষকে তো আমি ২৪ ঘণ্টা সেখানে দায়িত্ব দিয়ে রাখতে পারি না। আবার কতদিন সেখানে তাদের দায়িত্ব দিয়ে রাখব, এটা বাস্তবসম্মত নয়। সেজন্য আমরা আমাদের মতো প্রতিদিন চেষ্টা করি। আমাদের লোক গিয়ে তাদের (হকার) উচ্ছেদ করে, আবার তারা বসে।

গুলিস্তানের যানজট নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন উল্লেখ করে উপ-পুলিশ কমিশনার আনোয়ার সাঈদ আরও বলেন, সমন্বিতভাবে যদি নিয়মিত উচ্ছেদ এক মাস, দুই মাস করা যায় তাহলে হয়তো একটা ভালো ফলাফল আসতে পারে বলে আমার ধারণা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বক্তব্য
ডিএসসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) রাজীব খাদেম বলেন, যানজট নিরসনের প্রধান দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের, সিটি করপোরেশনের নয়। ঢাকা সিটিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রাফিক বিভাগের প্রায় ৪ হাজার পুলিশ নিয়োজিত আছে। আমরা যেটা করি, আমরা রাস্তাঘাটগুলো কর দেই। এখন আবার নতুন করে চিন্তা করছি, ট্রাফিক পুলিশ ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে ট্রাফিক সিগনাল সিস্টেম চালু করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের। আর যানজটের বিষয়টি আমার একার বিভাগের ওপর নির্ভর করে না। আমার বিভাগে দুই-তিনজন ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন। আমরা দুই-তিনজন মিলে তো আর যানজট নিরসন করতে পারব না। ভেহিকেল কন্ট্রোলের বিষয়টি দেখে বিআরটিএ, বহুতল ভবনের বিষয়টি দেখে রাজউক, ডিএমপি করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। যানজট নিরসনে সিটি করপোরেশন একক কোনো সংস্থা নয়।

গুলিস্তান এলাকার যানজটের অন্যতম কারণ হকারদের ফুটপাত দখল, যা দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এই বিষয়ে সিটি করপোরেশন কী করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটার জন্য আমাদের (সিটি করপোরেশন) সম্পত্তি বিভাগ আছে। উচ্ছেদের বিষয়টি তারা দেখে। আমরা (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল) অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়টি দেখি। সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগ হকার উচ্ছেদ করে, তারা আবার এসে বসে যায়। মানুষ নিয়ম মানে না, আইন মানে না। ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করলেই গুলিস্তান এলাকার যানজট নিরসন হয়ে যাবে বলে মত এই কর্মকর্তার।

সিটি করপোরেশনের নিজেদের মধ্যে ও ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমন্বয়হীনতা আছে এটা পুরোপুরি বলা যাবে না। সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক পুলিশ নিয়মিত হকার উচ্ছেদ করছে, কিন্তু তারপরও তারা আবার এসে বসে যাচ্ছে। রাস্তায় সব সময় থাকে পুলিশ। সিটি করপোরেশনের লোকজন সারাদিন সেখানে থাকে না। আবার আমাদের বল প্রয়োগের পাওয়ার নেই, সেটা আছে পুলিশের। পুলিশ যদি চায় তাহলে ফুটপাত ও রাস্তা হকারমুক্ত করতে পারে। কিন্তু তারা একটা দুইটা আইওয়াশের মতো উচ্ছেদ অভিযান করে, তারপর তাদের সামনেই আবার বসে। সিটি করপোরেশন তো শুধু গুলিস্তান নিয়ে কাজ করে না, পুরো ঢাকা শহর নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়।

গুলিস্তানে ঢাকার বাইরের গাড়ি আসা ও স্ট্যান্ড করে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী রাজীব খাদেম বলেন, বাসটার্মিনাল ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছি। এজন্য জায়গাও চিহ্নিত করা হয়েছে। যাতে ঢাকার বাইরের বাসগুলো ঢাকার ভেতরে আসতে না পারে। এটার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আছে, সেটা যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আশা করি গুলিস্তান এলাকায় যানজট থাকবে না।

ফুটপাত ও রাস্তা দখলমুক্ত করতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (উপসচিব) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বাংলানিউজকে বলেন, রাস্তা ও ফুটপাত দুটোই সিটি কর্পোরেশনের। তবে ফুটপাত দখলমুক্ত করা এককভাবে সিটি কর্পোরেশনের কাজ না। এখানে নিয়ম ভঙ্গ করে যারা ফুটপাতে দাঁড়াবে তাদের সরিয়ে দেবার দায়িত্ব কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের। কেউ যদি বিনা অনুমতিতে কোনো কিছু দখল করে অথবা এই কারণে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এই বিষয়ে আইনি এখতিয়ার কিন্তু সংশ্লিষ্ট থানায় দেওয়া আছে। এখানে পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে। তারা ভিআইপি মুভমেন্ট হলে তখন ঠিকই রাস্তা ফাঁকা করতে পারে। তবে হকারদের বিষয়ে কেন পারছে না?

তিনি আরও বলেন, যেহেতু পুলিশের লোকবল আছে এবং তাদের টহল টিম প্রতিনিয়ত ঘোরাঘুরি করে, সে ক্ষেত্রে এবিষয়ে তাদের করার অনেক কিছু আছে। সিটি কর্পোরেশনের কিন্তু নিজস্ব বাহিনী নেই, যেটা পুলিশের আছে। রাস্তা ও ফুটপাত যেহেতু আমাদের, তাই কেউ এসব দখল করলে আমরা উচ্ছেদ করে দেই। কিন্তু দেখা যায় সকালে উচ্ছেদ করলে দুপুরে হকাররা আবারও চলে আসে। এ ছাড়া বড় আকারেও যদি উচ্ছেদ করা হয় তাহলে কয়েকদিন তারা বসে না। কিন্তু পরবর্তীতে জীবিকার তাগিদে তারা আবারও চলে আসে।

বিশেষজ্ঞের মতামত
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, গুলিস্তান এলাকার পুরোটাই হকারদের দখলে থাকে। পাশাপাশি এই এলাকায় সব ধরনের যানবাহন চলাচল করে। যেমন: বাস, রিকশা, সিএনজি। অনেক মার্কেট থাকায় এই এলাকায় প্রচুর মানুষেল আনাগোনাও হয়। এছাড়া সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস এই এলাকায়। সব মিলিয়ে এই এলাকায় প্রচুর যানজট তৈরি হয়।

তিনি আরও বলেন, এই এলাকার যানজট নিরসনে প্রথমত ফুটপাত থেকে হকারদের সরাতে হবে। হকার সরাতে জনবল প্রয়োজন হয় না। এটার জন্য প্রয়োজন সিদ্ধান্ত যে, আমি তাদের বসতে দেবো না। প্রয়োজনে তাদের এক মাস, দুই মাস বা ছয় মাস সময় দিয়ে উচ্ছেদ করতে হবে বা সময় বেঁধে দিয়ে তাদের বসতে দেওয়া যেতে পারে। এখানে সিটি করপোরেশন ও পুলিশ দুই পক্ষকেই সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

মানুষের রাস্তা পার হওয়ার জন্য গুলিস্তান এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ তৈরির সুযোগ নেই উল্লেখ করে কাজী সাইফুন নেওয়াজ আরও বলেন, মানুষ যাতে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার না হতে পারে, সেজন্য রাস্তার ডিভাইডার উঁচু করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০২৪
এসসি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।