ঢাকা: ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আমার সহযোদ্ধা ফজলুর রহমানকে খান আকরাম হোসেন ও আব্দুল লতিফ তালুকদারসহ কয়েকজন রাজাকাররা বাগেরহাটের তেলিগাথি বাজারের দক্ষিণে খালপাড়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। এ ঘটনা আমি আড়াল থেকে দেখতে পাই।
৫ নভেম্বর সিরাজ মাস্টার, খান আকরাম হোসেন এবং আব্দুল লতিফ তালুকদারসহ রাজাকাররা বাগেরহাটের শাখারিকাঠি বাজার আক্রমণ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪০ জন লোককে আটক করে হত্যা করেন বলেও আমি শুনতে পাই।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানকালে এসব কথা বলেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব নকিব। তিনি সিরাজ মাস্টার, লতিফ তালুকদার ও খান আকরামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৫তম সাক্ষী।
রোববার (২৫ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেন সোহরাব নকিব। সাক্ষ্যগ্রহণে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন। সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীকে জেরা শুরু করেছেন সিরাজ মাস্টারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় সোমবার (২৬ জানুয়ারি) পর্যন্ত মুলতবি করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
বর্তমানে আনুমানিক ৬৪ বছর বয়সী সাক্ষী সোহরাব নকিব বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার বিলকুল গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল আনুমানিক ২১ বছর। সে সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তেলিগাথি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন।
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর স্বচক্ষে দেখা ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাক্ষী সোহরাব নকিব বলেন, এদিন সহযোদ্ধা সোলায়মান সরদারের মাকে দেখার জন্য ক্যাম্প কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে আমি, সোলায়মান সরদার, লুৎফর রহমান নকিব, মজিবর খান, মান্নান শেখ, জব্বার খান, ফজলুর রহমান ভাটখালী ক্যাম্প থেকে তেলিগাথি বাজারে আসি।
বাজারের দক্ষিণ পাশে অন্যদের রেখে আমি ও ফজলুর রহমান সিগারেট কেনার জন্য রওনা হই। কিন্তু এক পর্যায়ে আমি ব্রিজের গোড়ায় দাঁড়ালে ফজলুর রহমান বাজারের ভেতর ঢুকে পড়েন।
বাজারে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে খান আকরাম হোসেন, আব্দুল লতিফ তালুকদারসহ কয়েকজন রাজাকার তাকে ধরে ফেললে তিনি চিৎকার দেন। ওই চিৎকার শুনে আমি দৌঁড়ে মুচিবাড়ির কাছে অন্যান্য সহযোদ্ধাদের কাছে যাই।
সেখানে গিয়ে আড়াল থেকে দেখতে পাই, রাজাকাররা ফজলুর রহমানকে বাজারের দক্ষিণে খালপাড়ে নিয়ে যায়। খান আকরাম হোসেন প্রথমে তাকে গুলি করেন। পরে আব্দুল লতিফ তালুকদার ও রুস্তম মোল্লাও তাকে গুলি করেন এবং মরদেহ খালে ফেলে দেন।
এ ঘটনার পর সোলায়মান সরদারের মাকে দেখতে না গিয়ে সেবাই ক্যাম্পে ফিরে যান বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন সাক্ষী।
তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়ে সবশেষে ট্রাইব্যুনালের আসামির কাঠগড়ায় বসে থাকা তিন আসামি শেখ সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনকে শনাক্ত করেন সাক্ষী সোহরাব নকিব।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর সিরাজ-লতিফ-আকরামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন আরও ১৪ জন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন দিলীপ দাস, শৈলেন্দ্র নাথ দাস, শহীদজায়া কমলা রানী চক্রবর্তী, তপন কুমার দাস, শহীদপুত্র অরুণ দাস, শহীদপুত্র নন্দলাল দাস, নিমাই চন্দ্র দাস, শহীদপুত্র আনন্দ লাল দাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজর আহমেদ এবং শহীদপুত্র সোবহান শেখ।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর তিন আসামির বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন।
গত বছরের ৫ নভেম্বর রাজাকার কমান্ডার ‘বাগেরহাটের কসাই’ বলে কুখ্যাত সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার এবং তার দুই সহযোগী আব্দুল লতিফ তালুকদার ও আকরাম হোসেন খাঁনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে পাঁচটি এবং আব্দুল লতিফ ও খান আকরামের বিরুদ্ধে ৩টি করে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাগেরহাটের শাঁখারিকাঠি বাজার, রনজিৎপুর, ডাকরা ও কান্দাপাড়া গণহত্যাসহ ৮ শতাধিক মানুষকে হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন এবং শতাধিক বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন। অন্যদিকে ৩০ সেপ্টেম্বর ও ২০ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন আব্দুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনের পক্ষে তাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর সরোয়ার হোসেন এবং শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের পক্ষে তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল হাসান।
গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অফিসে প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন ও শেখ মুশফিক কবির তাদের বিরুদ্ধে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।
তদন্ত চূড়ান্ত করে গত বছরের ২৫ আগস্ট এ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বরাবর দাখিল করেন তদন্ত সংস্থা। তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তদন্ত দল দীর্ঘ তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে এ চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রসিকিউশন এর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।
বাগেরহাটের এই তিন আসামির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ ৯টি ভলিউমে ৫ খণ্ডে কেস ডায়েরি করে অভিযোগ দাখিল করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ৯টি খণ্ডে মোট ৮শ’ ৪৪ পৃষ্ঠার তদন্তের ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ৬৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন তদন্ত সংস্থা।
ট্রাইব্যুনাল-১ গত বছরের ১০ জুন এ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ১১ জুন আব্দুল লতিফ তালুকদার, ১৯ জুন আকরাম হোসেন খাঁন ও ২১ জুলাই সিরাজ মাস্টারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
তাদেরকে সেফহোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কচুয়ার শাঁখারিকাঠি বাজারে গণহত্যার শিকার রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় এ তিনজনসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৫